আল্লাহর রাসূল হিশেবে নবিজীর আত্মপ্রকাশের পর, তাওহিদের বাণী প্রচারের প্রারম্ভকাল থেকেই আবু জাহেলের চাইতে বড় কোন শত্রুর মুখোমুখি মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হোন নি। হেন কোন অত্যাচার নেই যা আবু জাহেল নবিজীর ওপর করেনি। লাঞ্চনা, অপমান, অপদস্ত তো করতোই। শারীরিক আর মানসিকভাবে নবিজীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করা ব্যক্তি ছিলো এই আবু জাহেল।
নবিজীর সাহাবিদের ওপরও অকর্থ্য, নির্মম আর পাশবিক অত্যাচার নেমে এসেছিলো এই আবু জাহেলের ইশারায়। একত্ববাদের বাণী প্রচার যখন থেকে নবিজী এবং তার সাহাবাদের ব্রত হয়ে উঠে, তখন থেকে আবু জাহেল যেন ইসলামের এক অবধারিত শত্রু। তার কূটচাল, তার শত্রুতা, পাশবিকতা যেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ইসলামের প্রচার এবং প্রসারের সাথে। মক্কার প্রাথমিক সেই সময়গুলোতে, কেউ তাওহিদের বাণী প্রচারে নামবে কিন্তু আবু জাহেল তাতে বাগড়া দেবে না- এমনটা যেন ভাবাই যেতো না।
একদিন আবু জাহেল শপথ করে বলেছিলো, ‘মুহাম্মাদ যদি আগামিকাল প্রার্থনা করতে আসে, লাত এবং উযযার কসম! আমি পাথরের আঘাতে তার মস্তুক ছিন্নভিন্ন করে ছাড়বো’। এমন দুঃসাহস আর ঔদ্ধত্যে সেদিন কুরাইশেরা আবু জাহেলের পাশে ছিলো। তারা আবু জাহেলকে অভয়বাণী দিয়ে বলেছিলো, ‘এগিয়ে যাও হে আবুল হাকাম! আমরা তোমাকে বিজয়ী দেখতে চাই’।
পরদিন আবু জাহেল সত্যি সত্যিই হাতে মস্ত একখন্ড পাথর নিয়ে কাবা চত্বরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। সে অপেক্ষা করতে লাগলো নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য। তিনি এলে, হাতের পাথর দ্বারা আঘাত করে নবিজীকে খুন করবে।
ভোরবেলা নবিজী যখন কাবা চত্বরে এসে দাঁড়ালেন, পেছন থেকে আবু জাহেল তার পাথর হাতে নবিজীকে আঘাত করার জন্য উদ্ধত হলো। কিন্তু, সেদিন ব্যর্থ হয় আবু জাহেলের হত্যা-প্রচেষ্টা। সেদিন সে এমন এক ঘটনার মুখোমুখি হয়, যা দেখে সে হাতের পাথর ফেলে দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার সঙ্গী-সাথীদের কাছে ফিরে যায়। তারা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘ওহে আবুল হাকাম! তোমার তো মুহাম্মাদের মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। কি হলো তার? আর, এভাবে ছুটেই-বা এলে কেনো? তোমাকে তো খুব অস্থির আর দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে’।
আবু জাহেল বললো, ‘আমি সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদকে হত্যা করার জন্যে গিয়েছিলাম। আমি যখন পাথর দিয়ে তাকে আঘাত করার জন্যে উদ্ধত হলাম, ঠিক তখন আমি মুহাম্মাদ আর আমার মাঝে এমন এক দৈত্যাকার উট দেখতে পেলাম, বিশ্বাস করো, এমন উট আমি ইতোপূর্বে আর কখনোই দেখিনি। আমার মনে হলো, আমি যদি আর এক পা সামনে আগাতাম, ওই উট তাহলে আমাকে আস্ত গিলে খেয়ে ফেলতো। আমি এতোটা ভয় পেয়ে গেলাম যে, নিজের জীবন বাঁচাতেই আমি সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে এসেছি’।
সেদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা নিজ দায়িত্বেই নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করেছিলেন। আবু জাহেলের এমন শত্রুতা থেকে নবিজীকে বাঁচিয়ে নিতে তিনি এমন এক নিদর্শন আবু জাহেলের সামনে হাজির করলেন, যা দেখে আবু জাহেল রীতিমতো ভিমড়ি খেয়ে গেলো। নবিজীকে হত্যা তো দূর, নিজের প্রাণ সংশয়ে পড়ে সে নিজেকে বাঁচাতে দৌঁড়ে পালাল।
ইসলামের একেবারে প্রথম যুদ্ধ, প্রথম যে জিহাদ, সেই বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের লড়তে হয়েছে মূলত আবু জাহেল বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুসলিমদের প্রতিপক্ষ হিশেবে শত্রুশিবিরের নেতৃত্বের আসনে ছিলো সে।
যে আবু জাহেলের কারণে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো নবিজীর গোটা জীবন, যার কারণে বারেবারে বাধাগ্রস্ত হয়েছে দ্বীনের দাওয়াত, মুসলমানদের পেছনে যে লেলিয়ে দিয়েছিলো পুরো মক্কাবাসীকে, তার জন্যেই কি-না রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত তুলে আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলেন?
আবু জাহেলের এতো শত্রুতা, এতো ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন, নবিজীর ওপর এতো জঘন্য মিথ্যচারের পরও নবিজী তার হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে দুয়া করেছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন আবু জাহেলকে যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা হেদায়াত দান করেন। যেন আবু জাহেলের শত্রুতার হাত ইসলামের জন্য হয়ে উঠে বন্ধুত্বের পেয়ালা। আবু জাহেলের বিষেভরা মন যেন ইসলামের জন্য ভালোবাসায় ভরে উঠে। তার বিষাক্ত চোখে যেন শোভা পায় ভালোবাসার রঙধনু। দ্বীনের জন্য বাঁধার প্রাচীর হয়ে উঠা আবু জাহেল যাতে ইসলামের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, তার জন্যে দুয়া করেছিলেন নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি আল্লাহর কাছে বলেছেন, ‘হে পরওয়ারদেগার! হয় আবুল হাকাম ইবনে হিশাম অথবা ওমর ইবনুল খাত্তাবকে আপনি ইসলামের জন্য কবুল করুন’। নবিজী যখন এই দুয়া করছিলেন, তখন আবু জাহেল এবং ওমর ইবনুল খাত্তাব দুজনেই ছিলো ইসলামের ঘোরতর শত্রু। সবচেয়ে প্রকাশ্য, সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর জন্যেও দুয়া করতে কার্পন্য করেন নি নবিজী মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাদের হেদায়াতের জন্য তিনি হাত উঠিয়েছিলেন আল্লাহর দরবারে।
শত্রুর জন্যেও দুয়া করতে পারাটা একটা বিরাট গুণ। এই গুণে প্রতিবিম্বিত হয় ধৈর্যের আবরণ। একটা মানুষ কতোটা ধৈর্যশীল হলে সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুটার জন্যেও হাত উঠাতে পারেন? আমাদের চারপাশে আমরা যাদের জন্য দ্বীন পালনে হোঁচট খাই, যাদের কারণে আমরা লাঞ্চিত, অবাঞ্চিত কিংবা অপমানিত হই, কখনো কি তাদের হিদায়াতের জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দুয়া করেছি? কখনো আল্লাহর কাছে বলেছি, ‘ইয়া আল্লাহ! অমুক ব্যক্তির কারণে আমি দ্বীন পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। আপনি তার হৃদয়ে আপনার দ্বীনের বুঝ ঢেলে দিন, যাতে সে এবং আমি, উভয়ে নির্বিঘ্নে আপনার দ্বীন মেনে চলতে পারি’।
নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়টা ছিলো সাগরের মতো বিশাল আর আকাশের মতোন প্রশস্ত। তাইতো ঘোরতর শত্রুর জন্যেও তিনি দুয়ার হাত আকাশপানে উত্তোলণ করতে পেরেছিলেন।