একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্য ও বিভ্রান্তির মধ্যকার সূক্ষ্ম ব্যবধান অনুধাবন করা। তথ্যের দুনিয়ায় প্রবেশ এখন আর কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। ক্লিকেই হাতের মুঠোয় আসছে জ্ঞান, মতবাদ, মতপার্থক্য ও আদর্শের সংঘাত। তবে সমস্যা হলো—এই তথ্যে যেমন রয়েছে মুক্তি, তেমনি রয়েছে বিভ্রান্তি।
বিশেষ করে একজন মুসলিম শিক্ষার্থীর জন্য প্রশ্নগুলো আরও তীব্র:
- আধুনিকতা ও বিজ্ঞানময় চেতনায় বেড়ে ওঠা একজন ছাত্র কিভাবে কোরআনের বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে?
- যুক্তি ও অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক একাডেমিক পরিবেশে ঈমান কিভাবে টিকবে?
- বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের দ্বন্দ্বে কীভাবে একটি পরিপূর্ণ মানস গড়ে তোলা সম্ভব?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে হলে ফিরে তাকাতে হবে সেই ঐশী জ্ঞানের দিকে, যা শুধু মানবজাতিকে উপাসনা শেখায়নি, বরং চিন্তা করতে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইসলামের এই বিশেষত্ব হলো, এটি হৃদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ককেও আহ্বান জানায়। কোরআন একটি বিশ্বাসগ্রন্থ, কিন্তু সেই সঙ্গে এটি যুক্তিরও আহ্বান। এটি কেবল হুকুমের নয়, ব্যাখ্যারও গ্রন্থ।
কোরআন ও যুক্তির সম্পর্ক
১. চিন্তা-গবেষণার কোরআনিক নির্দেশনা
কোরআন এমন এক কিতাব যা কেবল ধর্মীয় অনুশীলনের আহ্বান দেয় না, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণের আহ্বান জানায়। অন্তত ৭৫০টি আয়াতে চিন্তা, অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ, তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর করার নির্দেশ রয়েছে। যেমন:
- তারা কি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি, দিন ও রাতের পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করে না? (আলে ইমরান -১৯১)
- তোমরা কি অনুধাবন করো না? (বাকারা – ৪৪)
- তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা জ্ঞান রাখে। (রূম – ২২)
এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে, কোরআনের দাবি ঈমান আনা blind faith নয়, বরং reflective conviction—যা মানুষের অন্তর ও বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তোলে।
২. আকল (বুদ্ধি)-এর মর্যাদা
ইসলামি পরিভাষায় ‘আকল’ (عقل) কেবলমাত্র চিন্তা নয়, এটি একধরনের আত্মিক বিচক্ষণতা—যা ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। আকল শুধু ‘লজিক’ নয়, এটি হিকমাহর (প্রজ্ঞার) সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন: “আকল ও নকল (ওহি) যদি উভয়ই সত্য হয়, তবে তাদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব হতে পারে না।”
আধুনিক যুক্তিবাদ বলে যে, কোনো বিষয় যাচাই করতে হলে তা অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কোরআনও একই কথা বলে—কিন্তু আরো উচ্চতর স্তরে, আত্মিক ও নৈতিক পরীক্ষায়।
রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতে যুক্তির স্থান
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন কেবল একজন নাবী ছিলেন, তিনি ছিলেন যুক্তিনির্ভর সমাজ-সংস্কারক। তাঁর দাওয়াত আবেগনির্ভর ছিল না, বরং বাস্তবতা ও যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
- যখন তিনি মুশরিকদের কাবার মূর্তিগুলোর অকার্যকারিতা বোঝাতে চেয়েছেন, তখন বলেন: “যারা নিজেদেরই রক্ষা করতে পারে না, তারা তোমাদের কি উপকার করবে?” এ হলো ধর্মীয় সংস্কারের এক যুক্তিপূর্ণ কৌশল।
- তাঁর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে (হিজরত, মদিনা সনদ, যুদ্ধকৌশল, সাহাবিদের শিক্ষা) যুক্তি, কৌশল, বাস্তবতা ও নৈতিকতার মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়।
এখানেই ইসলাম অন্যান্য ধর্মব্যবস্থার চেয়ে অনন্য—এটি প্রশ্ন করতে ভয় পায় না, বরং মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। এটি ঈমানকে এক বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনায় রূপ দেয়, যাতে ঈমান হয় উপলব্ধির, আবেগের নয়।
ইসলামী দর্শন ও যুক্তি: ইতিহাসে ফিরে দেখা
১. ইমাম আল-গাযালি ও দ্ব্যর্থহীন যুক্তি
ইমাম আল-গাযালি ছিলেন এমন এক চিন্তাবিদ, যিনি ইসলামি দর্শনে আত্মিকতা ও যৌক্তিকতার সমন্বয় ঘটান। তাঁর “তাহাফুত আল-ফালাসিফা” (The Incoherence of the Philosophers) গ্রন্থে তিনি মুসলিম সমাজে গ্রিক দর্শনের অন্ধ অনুকরণকে চ্যালেঞ্জ জানান। তবে তিনি দর্শনকে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি—বরং তিনি দর্শনের সেই অংশগুলো বাতিল করেন যেগুলো ওহির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি যুক্তি ও ওহিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ইসলামি বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি “আল-মুস্তাসফা ফি উসূল আল-ফিকহ”, যেখানে তিনি দেখান কিভাবে যুক্তি ব্যবহার করে শরীয়াহর মূলনীতি নির্ধারণ করা যায়। তিনি প্রমাণ করেন, যুক্তি ও নকল (ওহি) পরস্পরের সহায়ক, পরস্পরবিরোধী নয়।
২. ইবনে রুশদ (Averroes): যুক্তিবাদের ইসলামী রূপকার
ইবনে রুশদ ছিলেন ইসলামী আন্দালুসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম। তিনি অ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতবাদকে ইসলামি বিশ্বাসের কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, যদি আমরা ওহির সঠিক ব্যাখ্যা করি, তবে তা কখনোই যুক্তির পরিপন্থী হয় না। তিনি বলেন, “সত্য কখনো সত্যের বিরুদ্ধে যেতে পারে না।” তাঁর “ফাসল আল-মাকাল” গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেন যে শরীয়া ও দর্শন একই সত্যের দিকে আহ্বান জানায়, কেবল ভিন্ন পথ ব্যবহার করে।
৩. ইবনে খালদুন ও সামাজিক যুক্তিবিদ্যা
ইতিহাসে প্রথম সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ইবনে খালদুন তাঁর “মুকাদ্দিমা” গ্রন্থে যুক্তির আলোকেই সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার গঠনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করেন এবং দেখান, একটি সমাজের পতন বা উত্থান কেবল ভাগ্যের খেলা নয়—বরং যৌক্তিক কারণ ও মানবিক দুর্বলতার ফল। তাঁর সমাজ-তাত্ত্বিক পদ্ধতি আজকের আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অগ্রদূত বলেই বিবেচিত হয়।
আজকের বাস্তবতা
তথ্যযুদ্ধ ও ইসলাম
বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন এক অভূতপূর্ব জ্ঞান-আক্রমণের মুখোমুখি হয়। ইউটিউব, টিকটক, রেডিট, ইনস্টাগ্রামের মত প্ল্যাটফর্মে ইসলাম বিদ্বেষী কনটেন্ট কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কখনো ‘বিজ্ঞানের নামে’, কখনো ‘নারী স্বাধীনতার ছলে’, আবার কখনো ‘ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে’ পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেক্যুলারিজম, নাস্তিক্যবাদ, পোস্টমডার্ন রিলেটিভিজম এবং “নিউ এথেইজম” ধারার প্রভাবে এমন এক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত, অপ্রয়োজনীয় ও কাল্পনিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস বা হ্যারারি প্রজন্মের মধ্যে এমন এক ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছেন—যে ধর্ম মানেই কুসংস্কার, এবং বিজ্ঞানই একমাত্র মুক্তির পথ। এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম শিক্ষার্থীর দায়িত্ব হলো যুক্তির মাঠে নেমে, কোরআন-সুন্নাহ, ইতিহাস ও দর্শনের আলোকে এই একচোখা বিজ্ঞানবাদ ও ধর্মবিদ্বেষের যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করা।
আমাদের করণীয়:
১. ইসলামী বিশ্বাসের যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা আয়ত্ত করা: যেমন, কোরআন ও হাদীসের প্রেক্ষিতে ঈমান, আখিরাত, তাকদীরের যুক্তিমূলক ব্যাখ্যা শেখা।
২. তথ্য যাচাই ও প্রোপাগান্ডা বিশ্লেষণের দক্ষতা অর্জন করা: Fact-checking, source criticism, logical fallacy সনাক্তকরণ শিখতে হবে।
৩. ইসলামি জ্ঞানের বহুমাত্রিক শাখায় দখল গড়া: দর্শন, নৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক বুঝতে হবে।
৪. জ্ঞান ও ঈমানের সমান্তরাল বিকাশ ঘটানো: শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত ঈমান গঠন করতে হবে।
৫. ডিবেট ও লেখনীর মাধ্যমে জবাব প্রদান: মুসলিম তরুণদের উচিত তাদের ভাষাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মিডিয়া দক্ষতাকে ইসলাম-বিদ্বেষ মোকাবিলায় কাজে লাগানো।
ইসলামি জ্ঞানের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
বিজ্ঞান ও কোরআনের সমন্বয়
বর্তমান বিজ্ঞান আবিষ্কার অনেকাংশেই কোরআনের নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ:
- ভ্রূণতত্ত্ব: (সুরা আলাক ১-২) — আধুনিক এমব্রায়োলজির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ: (সুরা জারিয়াত – ৪৭) — Big Bang ও Expanding Universe তত্ত্বের পূর্বাভাস।
- জলের মধ্যেই জীবনের সৃষ্টি: (সুরা আম্বিয়া – ৩০) — বায়োলজিক্যাল সেল স্ট্রাকচারের বৈজ্ঞানিক সত্য।
এই বিষয়গুলো শুধু মুসলিমদের ঈমান বাড়ায় না, বরং অমুসলিমদের জন্যও যুক্তিনির্ভর আলোচনার একটি দরজা খুলে দেয়।
নৈতিক যুক্তির চর্চা
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি বিধান কেবল আরাধনার জন্য নয়, বরং একটি যুক্তিপূর্ণ সামাজিক কাঠামো গঠনের জন্য।
- সুদ নিষিদ্ধ: কারণ সুদ ধনীকে ধনবান, গরিবকে গরিবতর করে; এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।
- ব্যভিচার হারাম: কারণ এটি পারিবারিক কাঠামোকে ধ্বংস করে এবং সমাজে অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি করে।
- যাকাত: শুধুমাত্র দান নয়, এটি একটি সম্পদ পুনর্বণ্টন নীতি যা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনে।
নৈতিক যুক্তির চর্চা
ইসলাম কেবল তথ্য নয়, নৈতিকতার দিক থেকেও যুক্তিনির্ভর। হালাল-হারাম নির্ধারণে কোরআন শুধু বিধান দেয় না, তার যুক্তিও ব্যাখ্যা করে। যেমনঃ সুদের বিরুদ্ধে বিধানের পেছনে সমাজতান্ত্রিক অবিচারের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।
আজকের মুসলিম তরুণদের উচিত এমন এক ইসলামি জ্ঞানচর্চা করা, যেখানে কোরআনের আলো ও যুক্তির তীর একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। সে হবে চিন্তাশীল, বিশ্লেষণধর্মী, সমালোচনামূলক কিন্তু ঈমানদীপ্ত। তার জ্ঞান হবে ‘রশিদ’ (সঠিক পথের অনুসারী), তার যুক্তি হবে ‘মুবারক’ (কল্যাণময়), এবং তার চিন্তা হবে ‘ইবাদত’ (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে)।