“যদি আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি ইন্টারনেট নেই, তবে মনে হয় যেন পৃথিবী থেমে গেছে”—এমন কথা আজকাল অনেক তরুণের মুখে শোনা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট, যেন তরুণদের জীবনের অক্সিজেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে এটি যেমন জ্ঞান ও যোগাযোগের এক বিপ্লব, অন্যদিকে এর অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণ সমাজকে ধীরে ধীরে এক নৈতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে কে, কীভাবে এবং কেন এটি ব্যবহার করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রযুক্তি একটি নিরপেক্ষ নিয়ামত—যা সৎ কাজে ব্যবহৃত হলে উপকার বয়ে আনে, আর অসৎ কাজে ব্যবহৃত হলে এটি ফিতনার ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
আজকের তরুণরা এমন এক যুগে বড় হচ্ছে, যেখানে প্রযুক্তি তাদের চোখের সামনে এক বিস্ময়কর বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ৪০ মিনিট স্ক্রিনে কাটায়, যেখানে তরুণ প্রজন্ম (বিশেষ করে ১৮–২৪ বছর বয়সীরা) দিনে প্রায় ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় ব্যয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার আরও বেশি—প্রতি তরুণ গড়ে ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে স্ক্রিনে কাটায়, যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১ ঘণ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত BTRC-এর তথ্যমতে দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১৩২.৮ মিলিয়ন, যার মধ্যে ১১৯ মিলিয়ন মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৩.৭৪ মিলিয়ন ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি এখন একটি অপরিহার্য অংশ হলেও, এর অপব্যবহার ভয়ংকর আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে।
তরুণদের প্রযুক্তি আসক্তির কয়েকটি দিক:
- ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রলিং
- গেমিং আসক্তি (PUBG, Free Fire, ইত্যাদি)
- ওটিটি ও ইউটিউবে অশালীন কনটেন্ট
- ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব ও প্রেম
- মানসিক বিষণ্ণতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব
এইসব প্রযুক্তির ফাঁদ কেবল তাদের সময় নষ্ট করছে না; বরং ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাভাবনা, নৈতিকতা ও আত্মপরিচয়কে গ্রাস করে নিচ্ছে।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ: প্রযুক্তি ও তরুণদের মাঝে ভারসাম্য
প্রযুক্তি আজ আর কেবল একটি যন্ত্র নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে জীবনধারার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এর ব্যবহার মানব চরিত্র, সমাজ ও আত্মার ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা কোনো ধর্মব্যবস্থা উপেক্ষা করতে পারে না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে এই প্রযুক্তিগত বাস্তবতাকেও গভীরভাবে বিবেচনা করে।
প্রযুক্তি হারাম নয়, বরং এর নিয়ন্ত্রণহীনতা বিপজ্জনক
ইসলাম প্রযুক্তিবিরোধী নয়। বরং কুরআন ও সুন্নাহ বারবার জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরেছে, যা প্রযুক্তির মূল ভিত্তি। আল্লাহ তায়ালা বলেন: قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না—তারা কি সমান?” (সূরা যুমার: ৯) ।
এই আয়াতটি আমাদের শেখায়, জ্ঞানার্জন এবং তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ইসলাম সমর্থন করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও হিজরতের সময় আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, যা ছিল সে যুগের কৌশলগত “তথ্য প্রযুক্তি”।
কিন্তু ইসলাম চায় এই প্রযুক্তি যেন মানুষের খেদমতে আসে, তার নফসের গোলামে পরিণত না হয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রযুক্তিকে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিবর্তে উল্টো প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়েছে। যা কুরআনের ভাষায় “নফসের পূজা” (সূরা জাসিয়া: ২৩)।
ইসলামের উদ্দেশ্য: ভারসাম্য ও আত্মশুদ্ধি
ইসলাম চায় একজন মানুষ হোক পূর্ণাঙ্গ—দেহ, মন, আত্মা ও সমাজের ভারসাম্যে গড়া। এজন্য প্রযুক্তি হোক এমন এক উপকরণ, যা আত্মিক উন্নতির পথকে মসৃণ করে।
একটি হাদীসে রাসূল ﷺ বলেন: “الدين النصيحة“ — “দ্বীন হলো সদুপদেশ।” (সহীহ মুসলিম) এই হাদীসের আলোকে বলা যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারে একজন মুসলিমের উচিত প্রতিটি ক্লিক, স্ক্রল, পোস্ট এবং মেসেজকে পরিমিতিবোধের আলোকে যাচাই করা।
দৃষ্টি সংরক্ষণ: প্রযুক্তির অন্যতম চ্যালেঞ্জ
আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বিপদ হলো হারাম কনটেন্টের সহজলভ্যতা বা দৃষ্টির ফিতনা—বিশেষত তরুণদের জন্য। অশ্লীলতা আজ সহজলভ্য হয়ে গেছে স্ক্রিনের মাধ্যমে—সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ওয়েবসাইট, এমনকি বিজ্ঞাপনের ভেতরেও হারাম উপাদান গুঁজে দেওয়া হয়। কুরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন:
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কাজ সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।” (সূরা আন-নূর, আয়াত ৩০)
এই আয়াত প্রযুক্তির যুগেও প্রাসঙ্গিক—যে কেউ অনৈতিক কনটেন্ট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হয়। যখন একটি স্মার্টফোনে ক্লিক করেই অশ্লীলতা দেখা যায়, তখন এই আয়াতটি শুধু তাত্ত্বিক নয়—চরম বাস্তব ও সমসাময়িক নির্দেশনা হয়ে ওঠে। এটি স্পষ্ট করে যে প্রযুক্তি ব্যবহারে মুসলিমের জন্য নৈতিক সংযম অপরিহার্য।
সময়ের অপচয় বনাম আমলের গুরুত্ব
এই আয়াতে মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—সময়—এর গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি আসক্তি আজ আমাদের সময়কে এমনভাবে গ্রাস করছে যে, মানুষ সময়ের গুরুত্বই ভুলে যাচ্ছে। তরুণরা আজ কয়েক ঘণ্টা একটানা ভিডিও স্ক্রল করে, অথচ মাত্র ৫ মিনিট কুরআন তিলাওয়াত বা নামাজে কষ্টবোধ করে। এই বৈপরীত্য একটি আত্মিক সংকট—যা প্রযুক্তির অসতর্ক ব্যবহারের ফল।
প্রথমত, ইসলাম সময়ের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি দিয়েছে। আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনে তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি যে সম্পদটি হারাচ্ছে, তা হলো সময়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, ভিডিও গেম ইত্যাদিতে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন: وَالْعَصْرِ ﴿١﴾ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴿٢﴾ “সময়ের শপথ! নিঃসন্দেহে মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।” (সূরা আল-আসর, আয়াত ১-২)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সময়কে শপথ করে বোঝাচ্ছেন, যদি কেউ সময়কে অপচয় করে, তবে সে নিশ্চিতভাবে ক্ষতির পথে রয়েছে। প্রযুক্তি যদি সময়ের অপচয়ের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা মুসলমানের জন্য এক আত্মঘাতী ফাঁদ।
আল্লাহভীতির অনুশীলন: প্রযুক্তির মাঝে তাকওয়ার পরীক্ষা
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার এক ধরনের আত্মিক পরীক্ষা। ঘরে একা বসে ফোন বা ল্যাপটপে কী দেখা হচ্ছে, তা কেউ না জানলেও, আল্লাহ জানেন। ইসলামি জীবনধারায় এটাই হল “ইহসান”—
“أن تعبد الله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك“ “তুমি যেন আল্লাহকে দেখছ—এমনভাবে তাঁকে উপাসনা করো। যদি তা না পারো, তবে অন্তত এ বিশ্বাস রাখো, তিনি তোমাকে দেখছেন।” (সহীহ মুসলিম)
এই বিশ্বাস প্রযুক্তির ব্যবহারে এক “অদৃশ্য ফায়ারওয়াল” হয়ে কাজ করে।
প্রযুক্তিকে কাজে লাগাও, নিজে প্রযুক্তির শিকার হয়ো না
একজন মুসলিম তরুণের উচিত প্রযুক্তিকে নিজের আত্মিক উন্নয়ন, দ্বীন শিখা, ও সমাজসেবার কাজে ব্যবহার করা। প্রযুক্তি দিয়েই ইসলামিক অ্যাপ বানানো যায়, দাওয়াহ ভিডিও বানানো যায়, অনলাইন ক্লাস নেওয়া যায়, আলেমদের খুতবা শোনা যায়। প্রযুক্তিকে যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করি, তাহলে সেটি একটি ইবাদতের মাধ্যমেও রূপ নিতে পারে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্বীনের ওপর থাকার চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে গেছে। যেভাবে নাস্তিকতা, সংশয়বাদ, বিকৃত ইসলামি ভাবধারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, তা তরুণদের জন্য বিশাল ফিতনা। রাসূলুল্লাহ ﷺ পূর্বাভাস দিয়ে বলেন: يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ، الصَّابِرُ فِيهِمْ عَلَى دِينِهِ كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ
“মানুষের উপর এমন সময় আসবে, যখন কেউ যদি দ্বীনের উপর অটল থাকতে চায়, তবে তার অবস্থা হবে এমন, যেন কেউ হাত দিয়ে আগুনের অঙ্গার ধরে রেখেছে।”
— (সুনান আত-তিরমিজি, হাদীস: ২২৬০)
এখনকার প্রযুক্তি-আশ্রিত সমাজে মুসলমান তরুণদের ঈমান টিকিয়ে রাখাটাই যেন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেউ একা বসে কী দেখছে, কী শুনছে, কাদের অনুসরণ করছে—এসব নির্ধারণ করে তার আখিরাতের ভবিষ্যৎ।
ইসলামি করণীয়: প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে তরুণদের জন্য দিকনির্দেশনা
১. নিয়তের পরিশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি তৈরি
প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিটি ক্লিকে আল্লাহর উপস্থিতি স্মরণ রাখা। “اتق الله حيثما كنت” – “তুমি যেখানেই থাকো, আল্লাহকে ভয় করো।” (তিরমিজি)
২. নিয়মিত সময় নির্ধারণ ও স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ
- নির্দিষ্ট সময় প্রযুক্তির জন্য
- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ২ ঘণ্টা প্রযুক্তিমুক্ত থাকা
- ‘Digital Fasting’ প্র্যাকটিস
৩. পরিবার ও সমাজে ইসলামি পরিবেশ গঠন
- পরিবারের তরফে প্রযুক্তির ওপর নজরদারি
- মোবাইলে parental control
- যৌথভাবে ইসলামি আলোচনার পরিবেশ
৪. সঙ্গবদ্ধতা ও বাস্তব জীবনে ইনভলভমেন্ট
- মসজিদভিত্তিক ইয়ুথ প্রোগ্রাম
- খেলাধুলা, কুইজ, ইসলামি ডিবেট
- ইসলামি Mentorship Circle
৫. ইসলামি মিডিয়ার প্রসার ও ব্যবহার
- হালাল Islamic Content Creation এ তরুণদের উৎসাহ
- ইসলামি ভিডিও এডিটিং, ডিজাইন, লেখা
- ইসলামি নিউজপোর্টাল ও দাওয়াহ চ্যানেল প্রতিষ্ঠা
প্রযুক্তি হোক নিয়ন্ত্রিত নিয়ামত
প্রযুক্তিকে দোষ দেওয়া যাবে না। এটিকে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিই মূল বিষয়। তরুণদের সামনে আজ দুটি পথ—
১. প্রযুক্তির দাস হয়ে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া,
২. অথবা প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে যাওয়া।
ইসলাম আমাদের শেখায় কীভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, আলোকিত ও আত্মিকভাবে সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়। “الدين النصيحة“ – “দ্বীন হলো সদুপদেশ” (সহীহ মুসলিম)।
পরিশেষে বলা যায়, কুরআন ও হাদীস প্রযুক্তিকে হারাম বলে দেয়নি, বরং আমাদের নৈতিকভাবে প্রস্তুত করেছে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। একজন মুসলিমের প্রযুক্তি ব্যবহার এমন হওয়া উচিত যেন তা তাকে আল্লাহর আরও নিকটবর্তী করে, না যে তা ঈমানকে দুর্বল করে দেয়। এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই ইসলামের অনন্য শিক্ষা।