ইসলামী সভ্যতার পতনের (সাময়িক) পর মুসলিম যুব সমাজের জন্য অতীব জরুরী বিষয় হচ্ছে ইতিহাসের সামগ্রিক বয়ানকে, স্বর্ণালী সভ্যতার ইতিহাসকে সামনে হাজির করা, জারি রাখা। কথিত আকস্মিক সমাধান, কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাতামাতির বদলে মুসলিম যুবসম্প্রদায়ের আত্নবিশ্বাসী হওয়া, সংগ্রাম করা ও সম্মুখ পানে এগিয়ে চলার জন্য ইহা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ইতিহাসের কোন বই না হওয়া সত্ত্বেও এর দুই তৃতীয়াংশ ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? কেননা ইতিহাসকে ভালভাবে জেনে ও বুঝে ভবিষ্যৎ এর দিকে যাত্রা করতে হয়। এছাড়া সঠিক রূপরেখা অংকন ও মুক্তি অসম্ভব।
কিন্তু এক্ষেত্রে সবথেকে বড় একটি সংকট হচ্ছে- গোটা উম্মাহর সন্তানেরা আমরা ইসলামের ইতিহাসকে পড়ি সংকট কেন্দ্রিক। সেক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।
১. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) জীবনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সর্বমোট ৫৩ দিন। কিন্তু আমাদের সমাজে বিদ্যমান থাকা সিরাত পাঠ করলে মনে হয় সারা জীবন যুদ্ধে অতিবাহিত করেছেন। ইতিহাস, সিনেমা, ডকুমেন্টারি যা দেখি সবাই যুদ্ধ/মাগাজি/দ্বন্দ্ব দিয়ে ভরা। অথচ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) এর ৬৩ বছরের মাত্র দুইমাস যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন; তাহলে ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও সকল ব্যবস্থা নিয়ে কাজের পর্যালোচনা ও শিক্ষাগুলো কোথায়! যোগ্য লোক তৈরির বিশাল কন্টাকীর্ণ পথ নিয়ে কোন কাজই চোখে পড়ে না!
আল্লাহর রাসূলের সামগ্রিক কর্মতৎপরতা ও ভূমিকা রাখার ব্যাপারে তো কারোরই দ্বিমত নেই, তাহলে এমন কেন!
২. যেমন মুয়াবিয়া (রা.) সময় কালের কথা চিন্তা করুন।
- স্পেন থেকে ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারত বিশাল অঞ্চল অর্ধ জাহান) তার অধীনস্থ ছিল।
- ২২ বছরের শাসনামলে নেই কোন বিদ্রোহ।
- নেই কোন অর্থনৈতিক সংকট।
- সেরা প্রশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সমাজ ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা।
কিন্তু আমরা তৎকালীন ক্ষমতা সম্পর্কীয় দুটি দ্বন্দ্ব/যুদ্ধের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকে পাঠ করি সংকট কেন্দ্রিক। যার ফলে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোকে জানতেও পারছি না, পর্যালোচনাও করছি না।
এখানে বলে রাখা ভালো, মাওলানা মওদূদীর ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা একটি পর্যালোচনা গ্রন্থ। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে পাঠ করতে পারিনি। এ ধরনের পর্যালোচনা গ্রন্থ কে পাঠ করার জন্য তিনটি বিষয় জানা আবশ্যক-
- ইতিহাস দর্শন।
- ইসলামের ইতিহাস।
- ইসলামিক সভ্যতার ইতিহাস।
এ বিষয়গুলো ভালভাবে না জেনেই পাঠ করার কারণে, একটি শ্রেণী না বুঝেই তার সমালোচনা শুরু করে। আবার আমরাও না বুঝে সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়েই, মাওলানার পক্ষে অন্ধ ডিফেন্স করতে শুরু করি।
৩. উমর (রা.) এর শাসনামল মানবতার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসনামল। কিন্তু তাকে পড়ার সময়, বলার সময় শুধু উনার ক্রোধ, যুদ্ধ আর আইনি শাস্তির ঘটনাটুকুই পড়ি। মনে হয় কতোটা যুদ্ধবাজ, অথচ উমর (রা.) রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে খলিফা থাকাকালীন একদিনও যুদ্ধে যাননি, আলী (রা.) কে পর্যন্ত যেতে দেননি। মূল বিষয় হলো,
- উমরা (রা.) এর অর্থনৈতিক বিপ্লব গোটা পৃথিবীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
- কৃষি, প্রতিরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, নগরায়ন, শিক্ষা ব্যবস্থা মানবতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত করে।
- শতশত আবিষ্কার, নতুন চিন্তা ও দুরদর্শী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তার সময়ে হয়েছে।
- তিনি যে কতোবড় মুজতাহিদ ও বিজ্ঞানী ছিলেন, তা তার আইন, অর্থনীতি, কৃষি ও নগরায়নের অসাধারণ উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করলেই অনুধাবন করা যায়।
কিন্তু কই সেই সামগ্রিক পড়াশুনা!
- উসমান (রা.) প্রথম ছয় বছরে উমরের মতই সফলতার সহিত বিশাল সালতানাতকে পরিচালনা করেছেন, কোন টু শব্দও হয়নি। তার ইতিহাস কোথায়? পর্যালোচনাও জানা নেই!
আলী (রা.) এর-
- অর্থনীতি, কৃষি, প্রতিরক্ষাও ছিলো অনন্য। উমর (রা.) এর মতোই অসাধারণ যুগান্তকারী অনেক সিদ্ধান্ত নেন, প্রয়োগ করেন। কিন্তু তার সময়কালীন দুটির যুদ্ধের কারণে আমরা তার সামগ্রিক ইতিহাস আমরা কেউই পড়ি না। বা জানিও না।
- তিনি খালিফা হবার আগে খোলাফায়ে রাশেদার ২৫ বছরে যে বিশাল অবদান রেখেছেন, সেটিও বলিনা! উমর (রা) এর সময় তিনি ছিলেন চিফ জাস্টিস। খলিফা সর্বদাই তাকে সাথে রাখতেন, কোথাও যেতে দিতেন না এবং যুদ্ধেও যেতে দিতেন না।
- উসমান (রা) এর সময় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
এসব অবদান নিয়েই বা কয়জন জানি আমরা? সেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে আগামীর ব্যবস্থা সাজানোর স্বপ্নই বা কয়জন দেখি? আমরা ইসলামকে পড়ার সময় পড়ি যুদ্ধের ইতিহাস, শাসনের ইতিহাস। আর নিজেরাও ফ্যান্টাসিতে ভুগি। যুদ্ধের ফ্যান্টাসি।
যেমন, দিরিলিস আর্তুরুল এমনভাবে বানানো হয়েছে যে, মনেহয় আর্তুরুলের জীবনে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। অথচ কত ত্যাগ, চিন্তা ও জ্ঞানের সফর, নিজেদের যোগ্যতা অর্জন, তারবিযয়্যাহ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবারসহ বিশাল এক সংগ্রামী পথ তারা পাড়ি দিয়েছেন।
কিন্তু সবই মনে হয় ঘোড়া আর তরবারি। সীরাত ও খোলাফায়ে রাশেদার নিয়ে আজ না হয় না-ই বললাম। তবে চিন্তা করলেই দেখা যায়, যেমন, মুয়াবিয়ার ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক পড়া, পর্যালোচনা করার কারণে আমরা ভালো দিকগুলো হারিয়ে ফেলি। কারণ আমরা তাদেরকে বিভিন্ন দিক থেকে চিনি না। শুধু সংকটের দিক থেকে চিনি।
এভাবে করেই পুরো ইসলামের ইতিহাসকে আমরা একটি সংকট বা এককেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ি ও জানি। সংকট বা এককেন্দ্রিক হওয়ার কারণে আমরা কোন সফলতা খুঁজে পাই না, পাচ্ছি না। আজগুবি কাহিনী দিয়ে ভরা আমাদের গ্রন্থ ও কাহিনীসমূহ। অহেতুক ফ্যান্টাসি দিয়ে ভরা প্রতিটি ইতিহাস। (ব্রাহ্মণ, খ্রিস্টান পাদ্রীদের মত আমরাও এসব আজগুবি কাহিনীই শুনতে ও বর্ণনা করতে অভ্যস্ত)। অথচ ইতিহাসের ক্ষেত্রে-
- ক্রিটিকাল থিংকিং করা।
- শিক্ষা গ্রহণ করা। চিন্তার উপাদান তৈরি করা।
- হৃদয় মনের মযবুতি অর্জন করা।
- নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করা।
- সমালোচনা, পর্যালোচনা করার যোগ্যতা।
- বিভিন্ন সোর্স থেকে পড়া। এবং
- আকল খাটানোর যোগ্যতা থাকলে উম্মাহর অবস্থা আজ এই হতো না! (নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ, আকলের ব্যবহার ও যৌক্তিকভাবে ইতিহাসের পর্যালোচনা কিভাবে করতে হয়, নাজমুদ্দিন এরবাকানের ‘ইসলাম ও জ্ঞান’ নামক ছোট্ট বক্তব্য/বইটি পড়লেই তা অনুধাবন করা যায়।)
আজ আমরা ইতিহাস বলতে বুঝি ক্ষমতার ইতিহাস। অর্থনীতি বলতেই বুঝি যাকাত-ফিতরা। চিন্তা করে খুঁজে পাইনা।
- ইসলামিক সভ্যতার ইতিহাস।
- ইসলামী দর্শনের ইতিহাস।
- ইসলামী অর্থনীতির ইতিহাস।
- ইসলামী রাজনীতি ও প্রশাসনের ইতিহাস।
- ইসলাম প্রচারের ইতিহাস।
- ইসলামী সংস্কৃতি, শিল্পকলার ইতিহাস।
- ইসলামে শহর, স্থাপত্যের ইতিহাস।
- ইসলামের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাস।
- ইসলামের সামাজিক ব্যবস্থা, পরিবারের ইতিহাস।
- ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস।
- ইসলামের বিজয় অভিযান, সম্মুখ যুদ্ধের ইতিহাস।
- ইসলামের প্রজ্ঞাবান আলেমদের ইতিহাস। (শাসকদের সাথে আলেমদের দ্বন্দ্ব ছিলো! বহু আলেম তাই হাইলাইট হয় না আমরা জানিও না!)।
- ইসলামী জ্ঞানের ইতিহাস।
- ইসলামী চিন্তার ধারাবাহিক উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
প্রতিটি বিষয়ের উপর শতশত গ্রন্থ প্রয়োজন। দারস ও পর্যালোচনা প্রয়োজন, গবেষণা প্রয়োজন। এই সকল ইতিহাস ও তার পর্যালোচনা কি আদৌও আমরা জানি? এছাড়া কীভাবেই আমাদের নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ সম্ভব?
আবার,
- আল্লাহর রাসূল (সা) এর সীরাত।
- প্রেক্ষাপটের আলোকে নবী-রাসূল দের সংগ্রাম।
- অনান্য সকল সভ্যতার ইতিহাস।
- সকল ধর্মের ইতিহাস।
- প্রতিটি অঞ্চলের ইসলামের ইতিহাস। এবং
- বর্তমান দুনিয়ার সামগ্রিক অবস্থান।
উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে কী আমরা ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে বুঝার প্রচেষ্টা চালাই? তাহলে কীভাবেই বা ইসলামী সভ্যতার বয়ান আমরা যৌক্তিকভাবে হাজির করার স্বপ্ন দেখি?
এভাবেই ইসলামী সভ্যতার ১২০০ বছরের ন্যায়ভিত্তিক দুনিয়া নিয়েও আত্নবিশ্বাস পাই না। কারণ সব চিন্তাই শাসক ও সীমানা কেন্দ্রিক। অথচ একবারও ভাবি না সীমানা কমবেশি হওয়া, কিছু শাসকদের সমস্যা থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু গোটা অর্থনীতি, খনিজ সম্পদ কাদের হাতে ছিলো, পররাষ্ট্রনীতি কারা নিয়ন্ত্রণ করতো, কাদের চিন্তা ও পদ্ধতি দ্বারা গোটা দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা প্রভাবিত ছিলো, জ্ঞান ও উদ্ভাবন কাদের হাতে ছিলো, সংস্কৃতিক প্রভাব বলয় কত উচ্চপর্যায়ে ছিলো। প্রতিরক্ষা, নৌপথ, আবিষ্কার সবই কাদের আদালত পূর্ণ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতো।
সামগ্রিক ভাবে পড়তে পারলে আমরা নিজেরাও আগামীর কর্তব্য খুঁজে পেতাম, নিজেরা শক্তিশালী হতে পারতাম, ইসলামরে শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে পারতাম। প্রয়োজন সামগ্রিকতার। সামগ্রিক চিন্তা ও পড়াশুনা। সামগ্রিক কর্মতৎপরতা। সর্বশেষ স্মরণ করছি প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান এর কথাটি, ‘মানুষের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে এমন ভাবে তুলে ধরা, যেন তারা আপনার যুক্তি ও কথার বিপরীতে অন্য কোন যুক্তি দাড় করানোর সাহসও না করতে পারে। শ্রোতার কিংবা উদ্দেশ্যকৃত ব্যক্তির মাথায় পুঞ্জীভূত সকল প্রশ্নের জবাব এমন ভাবে দিবে যেন সে সম্পূর্ণভাবে তোমার সাথে একমত পোষণ করে’।
আর এই জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক জ্ঞানের, যারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমান করতে চায় তাদের উচিত হল সমসাময়িক সকল জ্ঞান ও মতবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখা।