আমাদের আলোচনার শিরোনাম হলো, একুশ শতকের ধর্ম (বা মতাদর্শ) হলো লিবারেলিজম। আমরা মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনাটা সাজাবো।
- লিবারেলিজমের ইতিহাস।
- ইসলামের সাথে লিবারেলিজমের সংঘর্ষ।
- তুলনাগুলোর ভিত্তিতে একটি উপসংহার।
আমরা এখানে সংঘর্ষের সাথে সাদৃশ্য নিয়েও কথা বলবো। অনেক ভাই এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে খুব হীনমন্যতায় ভোগেন। তারা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন না। তারা বলেন যে মানবাধিকার তো আমাদের এখানেও আছে। সমস্যা হলো মানবাধিকার খুব আপেক্ষিক একটা বিষয়। ১৯৪৮ সালের পরে ৩০টি আর্টিকেলে জেনেভা কনভেনশন দিয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু মানবাধিকারকে ‘ওয়াহীর’ মর্যাদা দেওয়া হয়।
তারপর আমাদেরকে বলা হয় যে খৃস্টানদের মতো করে উন্নতিকে বুঝে নিতে হবে, তাদের মতো করেই উন্নত হতে হবে। কিন্তু আমাদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব না। আসুন, কথা বলি Epistemological Basis নিয়ে। এর মানে হলো পৃথিবীর ব্যাপারে অনুভূতি সৃষ্টি। অর্থাৎ আপনি কীভাবে পৃথিবীকে বুঝবেন তার ব্যাখ্যা। এখানে এসে আমরা লিবারেলিজমের মূল ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করি।
জন লক ছিলেন লিবারেলিজমের একজন ফাউন্ডিং ফাদার। লিবারেলিজমের ভিত্তি স্থাপনে তার অবদান অসামান্য। তিনি প্রথমে কথা বললেন Hedonistic Principle নিয়ে। এখানে ব্যাখ্যা করা হয় যে আমাদের নৈতিকতা কেবল সুখ ও দুঃখ দিয়েই বিচার করা হবে। উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যে ‘অধিক পরিমাণে সুখ’। মানে হলো আমরা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ নিশ্চিত করবো।
দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো তত্ত্ব। জন লক সবসময় স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে যুক্তি আনতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমাদেরকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে’। Two Tracts on Government ধরণের বইয়েও তিনি বাইবেল থেকে যুক্তি এনেছেন। আসলে লিবারেলিজমের অনেক নৈতিক ভিত্তিই কোনো না কোনো ধর্ম থেকে এসেছে। এ কথাই ধরুন, ‘সবাই সমানভাবে সৃষ্ট’। আমেরিকা, ফ্রান্সসহ অনেক দেশের সংবিধানেই এ কথা আছে। জন লক নিজে একজন আস্তিক ছিলেন। তিনি স্রষ্টায় বিশ্বাস করতেন।
আজকাল নাস্তিকতার ব্যাপক উত্থান হলেও রাজনীতিবিদরা ঠিকই এ বাক্য ব্যবহার করেন। জন লক এ যুক্তির পেছনে ব্যবহার করেছেন ধর্মকে। আপনি কীভাবে এটা প্রমাণ করবেন? Naturalism দিয়ে? Naturalism এর মতে, আমরা মৌলিকভাবেই আলাদা। আপনি কি আপনার মতোই একেবারে একইরকম আরেকজনকে আনতে পারবেন, যে কিনা আপনার মতোই লম্বা, একই বর্ণের, ইত্যাদি?
নাস্তিকতার মূল ভিত্তি ডারউইনিজমের মতেও কিন্তু আমরা সমান না। তার Survival of the fittest ধারণা অনুসারে, প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা সংগ্রাম ও প্রত্যেকে নিজস্ব সংগ্রাম অনুসারে পরিণত হয়। তাহলে আজকের দিনে কীসের ভিত্তিতে সবাইকে সমান বলা হচ্ছে? রবার্ট ফিল্মা ও জন লক তো আলোচনা করছিলেন যে বাইবেল কোন ধরণের সাম্যের কথা বলছে। অথচ কোনো ভিত্তি ছাড়াই আজকের মিডিয়া, একাডেমিকরা এগুলো প্রচার করে যাচ্ছে।
জন লক এমন একজন মানুষ যাকে নিয়ে পিএইচডি করা হয়। আজকের লিবারেলিজম তার হাত ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। আজকের লিবারেলিস্টরা তার চিন্তাকেই আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে। তিনি সাম্যকে ভিন্ন একটি ভিত্তিতে চিন্তা করতেন। সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। সব সাম্যবাদী লিবারেল পণ্ডিতরা হয় ধর্ম নয় মিথের ভিত্তিতেই সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মিথ বলতে কী বোঝেন? মিথ শুনলেই আপনার মাথায় নিশ্চয় হিন্দু বা গ্রিক দেবতার কথা মাথায় আসে। অবশ্য কোরআন কিংবা জেনেসিসের কথাও আসতে পারে। আপাত ধরে নেওয়া কোনো বিষয়কে আমাদের মিথ মনে হয়। লিবারেলিজমেরও এমন মিথ আছে।
Individualism হলো আরেকটি তত্ত্ব যা অধিকাংশ লিবারেলরা প্রমোট করে। এর তত্ত্বের মূলকথা হলো মানুষ জানে তার জন্য কোনটা ভালো। Communitarianism এর সাথে Individualism এর নতুন তর্ক দাঁড়িয়েছে। মাইকেল সান্ডেলের মতো বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, আমরা স্বাধীন না। আমরা সমাজের উপর নির্ভরশীল। সামাজিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কোনটি আমাদের জন্য বেশি ভালো।
আসুন এবার ইতিহাস নিয়ে কথা বলি। কখন লিবারেলিজম শুরু হয়? মধ্য ১৭ শতকের দিকে এর জন্ম হয়। ইংরেজ গৃহযুদ্ধ থেকে এর যাত্রা। আলোচনা শুরু হয়েছিলো পার্লামেন্টের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। জন লক ১৭০৬ সালে মারা যান। তিনি বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। তার বই Two Tracts on Government এ তিনি ইংরেজ আইনে Bill of law নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আইনে ব্যক্তিগত সম্পদ বা এসব কিছুর অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়।
কিন্তু লিবারেলিজমের বর্তমান স্রোত এসেছে ১৮ শতকের দিকে। জন লকের পর আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা এসে লিবারেলিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ধর্ম তখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
কিন্তু সমস্যা হলো, আব্রাহামিক ধর্মগুলোর সাথে লিবারেলিজম মৌলিকভাবেই যায় না। সেদিক থেকে মানুষ ধর্মের প্রতি আরো জাজমেন্টাল হতে থাকে ও লিবারেলিজম গ্রহণ করতে থাকে। রুশোও ছিলেন একটি কী-ফিগার। তারপর আসে ফরাসি বিপ্লব। বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে এ বিপ্লব হয়। ফরাসি বিপ্লবের কিছু ধারণা লিবারেলিজমে যোগ করা হয়।
ইমানুয়েল কান্ট খুবই প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন। পশ্চিমা অনেক চিন্তাভাবনাকে তিনি প্রভাবিত করেছেন। তার সময়ে অনেক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। তারপর এসেছেন জন স্টুয়ার্ট মিল। বর্তমানে সামাজিক অনেক নিয়ম কিংবা পশ্চিমা অনেক ধ্যান ধারণা তার থেকে গ্রহণ করা হয়। পোস্ট কলোনিয়াল সময়ের ভিত্তিতে তিনি প্রায়ই Beyond his time ব্যবহার করতেন। তার চিন্তাভাবনা ছিলো নাকি শতাব্দি পেরিয়ে। তিনি মহিলাদের কষ্ট নিয়ে অনেক কাজ করেছেন।
তিনি Harm Principle নিয়েও কাজ করেছেন। পরবর্তীতে জন এসে বললেন, হ্যাঁ, আমাদেরকে সুখের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কিন্তু গ্যাং রেইপের ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন? এখানে তো অধিকাংশ মানুষ আনন্দ পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে কেবল একজন। জন স্টুয়ার্ট এসে বললেন, আপনি অন্যের ক্ষতি না করে সর্বোচ্চ আনন্দ নিতে পারবেন। এটিই Harm Principle।
সমকামিতা, এনাল ইত্যাদি অনেক কিছুই এভাবে বৈধ হয়ে যায়। ইনসেস্ট বা অজাচারেও কিন্তু এমন আলোচনা করা যায়। অনেক দেশেই অজাচার বৈধ না, অথচ তারা নাকি লিবারেল। তারা অনেক ক্ষেত্রেই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড করে। তারা বিষয়টি প্রাকৃতিক না- এমন যুক্তি দেখায়। অথচ তাতে কিছু আসে যায় না। আজকাল তারা প্রাকৃতিক প্রমাণ করার জন্য বলে গে জীন আছে, অনেকে গে হয়েই জন্ম নেয়। তারা কি সামনে ইনসেস্ট জীনের কথা বলবে? ইসলামে Harm Principle নিয়ে কথা বলা হয় না।
অনেকেই জগাখিচুড়ি ধরণের আদর্শে বিশ্বাস করে। কিন্তু সব নৈতিক ভিত্তি কিন্তু যাচাই করে দেখা হয়নি। আজকাল রিদ্দার শাস্তি, ব্লাসফেমি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা হয়। এগুলো নাকি মৌলিক মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। মৌলিক মানবাধিকার কে ঠিক করে দিলো? জেনেভা কনভেনশন, যা কিনা একগাদা লিবারেল রথী-মহারথীদের সৃষ্ট? একে প্রাকৃতিক অধিকারও বলা হয়। জেরেমির ভাষায়, এটি একটি ননসেন্স। কোনটা প্রাকৃতিক বা কোনটা প্রাকৃতিক না- তা কে ঠিক করে দেবে? জেরেমি বেন্থম ছিলেন জন স্টুয়ার্টের শিক্ষক।
আপনি গুগল এনগ্রামে দেখুন। ১৯৪৮ সাল থেকে মানবাধিকার কথাটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। আগে সামাজিকভাবে নৈতিকতার একটি সংজ্ঞা নির্ধারিত ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিছু মানুষ এসে নিজের মতো করে কিছু অধিকার বানিয়ে নিলো এবং একে ‘আন্তর্জাতিক ও সার্বজনীন’ ঘোষণা করে দিলো। এ জেনেভা কনভেনশন ব্যবহার করেই শ্বেত সন্ত্রাসীরা বিশ্বজুড়ে তাদের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে।
এবার আসি লিবারেলিজমের মিথ নিয়ে। State of Nature লিবারেলিজমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টমাস হোবস, রুশোসহ অনেকেই এর ব্যাপারে কথা বলেছেন। বিষয়টি হলো অস্তিস্ত্বের আগের আনুমানিক অবস্থা। ধরুন, আমরা এ দেশে থাকি, এ দেশের নিয়ম মানতে আমরা বাধ্য। প্রশ্ন হলো, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারকে কে দিলো? লিবারেল তত্ত্ব অনুসারে, আনুমানিক একটা অবস্থা ছিলো, শূন্যতা। তারপর আমরা এ সরকার বানিয়েছি। নৈতিকতার সৃষ্টি, মানুষে মানুষে সংঘর্ষ এভাবেই চিত্রায়িত করা হয়। মানে আমরা একসময় মারামারি করতাম। তারপর নিজেদেরকে বাঁচাতে আমরা নৈতিকতা, সরকার এসব এনেছি। মজার ব্যাপার হলো, এমন কিছুই ঘটেনি। ইতিহাস বা বিজ্ঞান একে সমর্থন করে না।
পুরোটাই হলো রূপকথা। মূল আলোচনা এনেছেন লক। তার মতে, মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে, সরকার লাগবে, ইত্যাদি। পরে হোবস একে আরো বাড়িয়ে নতুন ধরণের এক অতীতের কথা বললেন। মানুষে মানুষে সংঘর্ষের কথা বললেন। তারপর সরকার, নৈতিকতা। একে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কিংবা আলোচনার সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, কে বা কারা এ নৈতিকতা ও ক্ষমতা এনে দিয়েছে।
আমাদের উত্তর পরিষ্কার- আল্লাহ। আল্লাহই নৈতিকতা দিয়েছেন, সামাজিক সংহতি দিয়েছেন। আদম (আ.) ও মানবজাতি আল্লাহর সাথে এক চুক্তি করে এসেছে। কিন্তু তারা আল্লাহকে সরিয়ে এক কাল্পনিক দানবকে এখানে বসায়। এটা কেন মিথলজি না? কারণ সাদা মানুষরা এটি লিখেছে? কারণ এটা সেক্যুলার? এটা বাস্তবিক অর্থেই পরিপূর্ণ এক মিথলজি।
ইমানুয়েল কান্ট বলেন, সরকার বা সেই কাল্পনিক দানব অনেক ক্ষমতার অধিকারী। হত্যা, লুট ইত্যাদিও ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। মানুষের স্বাধীনতাকে আইনের মাধ্যমে সীমিত করা হয়। এ প্রক্রিয়া হত্যারও জন্ম দেয়। তার মতে, কোনো যোদ্ধাকে ক্যাননের সামনে দাঁড়াতে বললে তাকে তাই করতে হবে। এটি ইলিবারেল কিছু না। এটি অনেকটা সুইসাইড বোম্বিং এর মতো। কিংবা তার চেয়েও খারাপ।
জন রুল বলেন, আপনি যুদ্ধে বেসামরিকদেরকে টার্গেট করতে পারবেন। কোলাটেরল ড্যামেজ না এটা। আপনি বাচ্চাকেও হত্যা করতে পারবেন।
ইসলামের ঐতিহ্যবাদ (Islamic Traditionalism) কী?
ইসলামের ঐতিহ্যবাদ হলো ইসলামের মূলধারার শারঈ ও ফিকহি বুঝ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইসলামের চারটি স্কুল অফ থট। আপনি কিতাবুল জিনায়াতের মতো ফিকহের বই খুলুন। সেখানে আপনি হাদ্দুর রিদ্দাহ বা ধর্মত্যাগের শাস্তির ব্যাপারে আলোচনা পাবেন। অনেক উলামাই বলেছেন, ইসলাম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আপনার মনে হবে, “একি! এটা কি মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্গন নয়?”
বর্তমানে মানবাধিকার বলতে যায় বোঝায় তা অবশ্যই লঙ্ঘন হয়। কিন্তু দেখুন, জন লক কি বলেননি যে সরকার যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে? জন লক বলেছেন, ধর্মত্যাগের শাস্তি থাকতে পারে সেক্যুলার আইনে।
“কমনওয়েলথের নাগরিকরা পরবর্তীতে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্কচ্ছিন্ন করে। তারা হাই ট্রিজনের মতো শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। ইয়াহুদীদের ধর্মশাসন ছিলো কমনওয়েলথের মতোই।” (Locke: 231)
জন লক ইসরাঈলের নাগরিক হওয়াকে দেখেন স্রষ্টার সাথে একটি কন্ট্রাক্ট হিসেবে। কেউ যদি মানুষের সামনে সরাসরি বলে যে সে ইয়াহুদী ধর্ম ত্যাগ করেছে, তাহলে সরকার তাকে হত্যা করতে পারে। মৌলিকভাবে তিনি কিছু ধর্মত্যাগের শাস্তি মেনেই নিলেন। অনেকে বলবেন যে এটা ৩০০ বছর আগের কথাবার্তা। আমার পয়েন্ট সেটা না। আমার পয়েন্ট হলো, ধর্মত্যাগের শাস্তিকে লিবারেল আইনে রাখা যায়। কেননা লিবারেলিজম সরকারকে অসীম ক্ষমতা দেয়। আপনি ব্যক্তিগতভাবে এ আইন অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু লিবারেলিজমেই সরকার চাইলে এ আইন প্রয়োগ করতে পারে।
কোনো রাষ্ট্র যদি বলে, আমরা গণতন্ত্র মানি না, ধর্মীয় আইনে চলি- তাহলে জন লক, ইমানুয়েল কান্ট, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রত্যেকের মতেই এতে কোনো সমস্যা নেই। এতে ইলিবারেল কিছু নেই। ট্রিজন এবং ধর্মত্যাগের শাস্তির মিল আছে। ট্রিজন হলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। আমেরিকার সংবিধান দেখুন। আর্টিকেল ৩ ট্রিজন নিয়ে আলোচনা করেছে। রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা, কাজ ইত্যাদির জন্য ব্যক্তিকে শাস্তির ব্যাপারে এখানে আলোচনা হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে আমেরিকা এটা করেছেও। বিনা বিচারে হত্যা করেছে। অনেকেই আনওয়ার আল আও লাকিকে চেনেন। তার ছেলে আব্দুর রহমান আল আও লাকি ও তার মেয়ে নাওয়ারকে আমেরিকা ড্রোন হামলা ও স্নাইপিং দিয়ে হত্যা করেছে। অথচ তাদের কী দোষ ছিলো? আপনি ৬ বছরের বাচ্চার কী বিচার করবেন? তারা তাঁর ও তাঁর বাচ্চাদের কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করেছে। বুঝা গেল, আপনি যখন আর রাষ্ট্রের বন্ধু নন এবং নাগরিক নন তখন তারা তাকে হত্যা করতে পারে। তারা একই কাজ করে অন্য নাম দেয়। দিনশেষে এটা রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা।
আসুন রিদ্দার শাস্তির ব্যাপারে। রিদ্দার শাস্তির ব্যাপারে অনেকেই যুক্তি দেখায় সে আয়াতের, “দ্বীনে কোনো জবরদস্তি নেই। অবশ্যই সত্য মিথ্যা থেকে পৃথক হয়ে গেছে”। [সূরা বাকারাহ: আয়াত ৩৪]
এ আয়াত হলো কাফিরদের জন্য। এটা দলিল হলে যে আয়াতের কী হবে? “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন (কিছু করার) ক্ষমতা নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” [সূরা আহযাব: ৩৬]
আপনি যদি ইসলামে অস্বীকার করেন সেটা গোপন রাখুন। সাহাবী হুজাইফার (রা.) কাছে মুনাফিকের লিস্ট ছিলো। মুনাফিক তারা যারা আসলে ইসলামে বিশ্বাস করে না কিন্তু মুসলিমদের মতো কাজ করে। কিন্তু না তিনি এগুলো প্রকাশ করেছেন, না মুসলিমরা তাদের হত্যা করেছে। অরিয়েন্টালিস্টরা এসব নিয়ে জল ঘোলা করে। এখন পশ্চিমে কি আমরা এ হদ কায়েমের কথা বলছি? নাহ! কারণ এটার সামাজিক কন্ট্রাক্ট নেই। আমাদের রাষ্ট্র নেই।
দ্বিতীয় পয়েন্টে আসি। আপনি বুখারির কিতাবুশ শুরুত বা Book of Condition দেখুন। সেখানে আপনি কুরাইশদের সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা আছে। কুরাইশরা বললো, কোনো মুসলিম যদি কাফিরদের সাথে যুক্ত হতে চায়, কাফির হয়ে যায় তাকে মক্কায় পৌঁছে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) তা মেনে নিলেন। বুঝা গেলো, লিবারেল রাষ্ট্র কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রে ট্রিজন বা ধর্মত্যাগের শাস্তি একই। চাইলে উভয় রাষ্ট্রই পরিস্থিতি অনুসারে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
জন গ্রের মতে, কেন আমাদের ট্রিজনকে হাদ্দুর রিদ্দার মতো মনে হয় না? কেননা শুনতে মনে হয় যে লিবারেলিজম সায়েন্টিফিক কথা বলে। অথচ লিবারেলিজমের একেবারেই প্রাথমিক নিয়ম বা নীতিগুলো কিন্তু প্রমাণিত কিছু নয়। তাদের বেশিরভাগ বিষয়ই মিথলজি, ফিকশন ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। এ ধরণের একটা আদর্শকে ইসলামের উপর চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই ফালতু কাজ।
একজন লিবারেল কীভাবে লিবারেলিজমকে যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে প্রমাণ করবে? তারা কীভাবে ভাবে যে আমরা তাদের মিথগুলো মেনে নেবো যেটা তারা নিজেরাই পুরোপুরি মানে না?
বাস্তবতা হলো, লিবারেলিজমের আমাদেরকে দেওয়ার কিছুই নেই। তারা মানবাধিকারের কথা বলেন। কিন্তু মানবাধিকার এমন একটি মেটাফিজিক্যাল ব্যাপার যে আপনি কখনোই সবকিছুর সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পাবেন না। এটা একেবারেই ননসেন্স। তারা এসবের প্রয়োগে গণতন্ত্রের কথা বলেন অথচ সেটাই কিনা হিটলারের মতো মাইনোরিটি জেনোসাইড নিয়ে আসতে পারে। তাদের প্রশ্নকেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে।
ওরিয়েন্টালিজম নিয়ে আমি যখন কথা বলি সেটা আসলে এডওয়ার্ড সাঈদের বই না। লিবারেল ওরিয়েন্টালিজম নিয়ে আমরা কথা বলছি। অনেক ওরিয়েন্টালিস্ট ও লিবারেল মুসলিমরা হুদুদকে রদ করে দিতে চায়। কিন্তু আমাদের হীনমন্যতায় থাকা যাবে না। এটা সত্য যে পশ্চিমে মুসলিম মাইনোরিটি হদ কায়েম করতে বলছে না কাউকে। এর জন্য রাষ্ট্র দরকার।
আসলে মুসলিমদেরকে চাপে রাখার জন্য এসব বলা হয়। কিন্তু যুক্তিতে আসলে লিবারেলিজম নিজেই এতে ফেঁসে যায়। তারা মুসলিম মেজরিটির স্বৈরশাসন নিয়ে কথা বলে। কিন্তু তারা দেখে না তারা নিজেরাই লিবারেলিজম চাপিয়ে দিয়ে মাথায় এক টুকরো কাপড়ের জন্য কড় আরোপ করে।
সত্যিকার অর্থে, ইসলাম স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইসলামের কারো থেকে কিছু নিতে হবে না। ফালতু মিথে ভর্তি লিবারেলিজম থেকে তো আমাদের জন্য আরো অপ্রয়োজনীয়।