সালমান শাহ। চিনেন না বা নাম শুনেন নাই এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কমই আছে। বলা হয় বাংলা মুভি ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়ক। ফিল্মের ব্যবসায়ীক সফলতাও তাই বলে। লাখো তরুণের আইডল ছিলেন তিনি। জনপ্রিয়তায় কমতি ছিলো না এক বিন্দুও। হাজারো তরুণীর স্বপ্নের নায়কও ছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত যার জনপ্রিয়তায় নূন্যতম কমতি নেই। সেই মহাজনপ্রিয় ব্যক্তি কিভাবে মারা গেছেন আমরা সবাই হয়তো জানি। সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত ছিলো তাঁর লাশ। অনেকেই আবার বলেছেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যাই হোক, স্বাভাবিক মৃত্যু তো হয় নাই মহাজনপ্রিয় এই ব্যক্তির।
মীর কে চিনেন? মীরাক্কেলের মীর!
যেই মীরাক্কেল দেখে হাজারো মানুষ কথিত আনন্দ পায়। ডিপ্রেশন থেকে বের হওয়ার জন্য হাজারো ডিপ্রেশড মানুষ মীরাক্কেল দেখে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চিন্তা করে, এই না হয় ডিপ্রেশন কমলো। কিন্তু! মীরাক্কেলের যিনি সর্বেসর্বা তিনিই ডিপ্রেশড হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাও আবার একবার নয়, চার চার বার। আর তাদের থেকে আনন্দ পেয়ে আমরা আনন্দিত হই।
সাহিত্যজগৎ-এ অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি ‘হান্টার এস থম্পসন’ কে সাহিত্য নিয়ে নড়াচড়া করা ব্যক্তিরা অবশ্যই চিনে থাকবেন। আমেরিকার সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিক। মৃত্যু হয়েছে আত্মহত্যা করেই। আত্মহত্যা করার চার দিন আগে তিনি সোসাইড নোট লিখেন। শিরোনাম ছিলো ‘ফুটবল খেলার শেষ মৌসুম’। তিনি এখানে লিখেন “আর কোনো খেলা অবশিষ্ট নেই। আর কোনো বোমা নেই। চলতে থাকা নেই। কোনো মজা নেই। সাঁতার কাটা নেই। ৬৭, ৫০। এরপরও ১৭টি বছর। আমার চাওয়ার অথবা দরকারের চাইতেও ১৭টি বাড়তি বছর। বিরক্তিকর। আমি সবসময়ই উদ্যম। কারো জন্য কোনো আনন্দ নেই। ৬৭, তুমি লোভী হয়ে যাচ্ছো। বুড়োমি দেখাও। শান্ত হও-এটা ব্যথা দেবে না।”
তাঁর লেখা উপন্যাস পড়ে অনেকেই মঝা আর আনন্দ পেয়েছেন, সামান্য সময়ে আনন্দের শিখরে সুখিও হয়েছিলেন আর তিনিই আত্মহত্যা করলেন। জনপ্রিয়তার কমতি ছিলোনা তাঁর। টাকা, পয়সা, গ্ল্যামার লাইফ সবই ছিলো তাঁর। লন্ডনের বেশ বড়-সড় একটা জায়গা অধিকার করে রেখেছিলেন উলফ। মৃত্যুর পরেও নিজের অন্যতম সেরা লেখা মিসেস ডেলোয়ে, টু দ্যা লাইটহাউস এবং অরলান্দোর মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন তিনি। তবে দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পেলেও সবটা সময় মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এই লেখককে। মনরোগে আক্রান্ত হতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর সেই বিরক্তি, ভয় আর হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর সেটার আগে লিখে যান চারটি লাইন।
“আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করছি যে আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি অনুভব করছি যে ওরকম আরেকটি ভয়াবহ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে পারব না আমরা। এবং আমি এবার সেরে উঠব না। আমি কণ্ঠ শুনতে আরম্ভ করেছি।”
জর্জ ইস্টম্যান ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত ‘কোডাক কোম্পানি’ এর প্রতিষ্ঠাতা। পৃথিবীর ফটোগ্রাফারদের কাছে কোডাক একটি পরিচিত কোম্পানি। সেই ‘কোডাক’ এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ইস্টম্যানও আত্মহত্যা করেন। সোসাইড নোট এ লিখে যান ‘আমার বন্ধুদের প্রতি, আমার কাজ শেষ। তাহলে অপেক্ষা কেন?’
পৃথিবীর এরকম শত শত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যে, যারা দুনিয়ায় বিখ্যাত ছিলেন, টাকা, পয়সা, যশ-খ্যাতি আর গ্ল্যামার লাইফের কোন কমতিই ছিলো না তাদের। কিন্তু!! হতাশার ভয়াল থাবায় আচ্ছন্ন হয়ে বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। আরেকটি ভয়ানক ইনফরমেশন দেই, পৃথিবীর অধিকাংশ তারকা বা বিখ্যাত ব্যাক্তি যারা আমাদের কাছে আইডল তাঁদের সাথে একটি সেল্ফি তুলার জন্য আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেও কুণ্ঠাবোধ করিনা সেরকম অধিকাংশ পরিচিত মুখই আজ সুখি নেই। হতাশা,আর মানষিক দুঃখ যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিসের অভাব তাদের?
অভাব হচ্ছে শুধু শান্তির, অভাব হচ্ছে মানষিক প্রশান্তির, অভাব হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যের, অভাব হচ্ছে ভালোবাসার। একচুয়ালি, যারাই আখেরাত কে ছেড়ে দিয়ে দুনিয়ার পিছনে ছুটবে তারা কখনই সুখি হতে পারবেনা। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সুখি মনে হলেও আসলে তা লোকদেখানো ধার করা সুখ। সুখ তো, তাঁর। যার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক বেশি। যে দুনিয়ার পিছনে হতদ্যম হয়ে ছুটতে থাকেনা বরং দুনিয়া তাঁর পিছনে ছুটে। কেননা, সে তো দুনিয়ার মালিকের বন্ধু।
‘সুখ’ মানে আসলে কি বুঝায়? সুখ মানে আত্মার প্রশান্তি। আত্মার প্রশান্তি বৈ টাকা, পয়সা আর যশ-খ্যাতির শো অফ নিছক অভিনয় মাত্র। আত্মার পরিতৃপ্তিতেই সুখ বিদ্যমান। পৃথিবীর মানুষদের শ্রেষ্ঠ গাইড বুক কোরআনুল কারিমে সুখ এর আলাদা অর্থ প্রদান করা হয়েছে। কোরআন সুখকে দুনিয়ার চাকচিক্য আর গ্ল্যামার লাইফকে সংজ্ঞায়িত করেনি, সুখ বলতে আল্লাহর নিকট নিজেকে সঁপে দেওয়াকেই বুঝিয়েছে কোরআন। অন্তর যখন প্রশান্ত, প্রফুল্ল ও আনন্দচিত্তে থাকে তখনই একজন মানুষ সুখী হয়।
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ‘সাকিনা’ শব্দ দ্বারা অন্তরের প্রশান্তি তথা সুখ বুঝিয়েছেন। আর কুরআন মাজীদের যেখানে ‘সাকিনা’ শব্দটি রয়েছে তারপরেই আল্লাহর উপর ভরসা, ইবাদাত, তাঁর কাছে সমর্পিত আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ সুখ বলতে ইহাকেই বুঝিয়েছেন।
বিপদ, মুসিবত, আর অপ্রাপ্তির ঘনঘটা মানেই কি দুঃখ? না, যতই মুসিবত থাকুক অন্তরের প্রশান্তি থাকলে সর্বাবস্থায়ই নিজেকে সুখি মনে হবে। যেমন: রাসুল ﷺ এবং আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যখন হিজরতের সময় মক্কা থেকে মদিনায় যাচ্ছিলেন। তখন তিনারা একটি গুহার মধ্যে নিরাপত্তার জন্য কিছুক্ষণ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তাদের একেবারে নাকের ডগায় কুরাইশ বাহিনী চলে আসে। সিদ্দিকে আকবার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তখন সামান্য সময়ের জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন।
এই বুঝি আমাদের ধরে ফেলল!! এরকম একটি ভয় তার মধ্যে কাজ করতে লাগলো। ঠিক সে সময়ই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদের আয়াত নাজিল করে রাসুল ও আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে সান্ত্বনা প্রদান করলেন এবং আশ্বাস দিলেন যে তিনি তাদের সাথেই আছেন। অতঃপর আল্লাহ তাদের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন। [সুরা তাওবা: ৪০ (মূলকথা)] ক্রমেই তাদের হতাশা আর ভয় কেটে গেল। কেননা আল্লাহই তো তাদের প্রশান্তি দান করেছেন। এ প্রশান্তির ওপরে দুনিয়ার কোন মুসিবত এবং বিপদের স্থান নেই।
‘সুখ’ কি তাহলে দুনিয়া পূজায়? বিশেষজ্ঞদের মতে, দুনিয়া পূজাই পৃথিবীর মানুষদের অসুখী হওয়ার প্রধান কারণ। কে কার চেয়ে বেশি ধনী হবে, কার চেয়ে বেশি সম্মানিত হবে কার চেয়ে বেশি রূপবান বা রূপবতী হবে এই নিছক দৌড়ের উপর যারাই থাকে তারা কখনোই সুখী হতে পারে না। হয়তো সে তার কাঙ্ক্ষিত যশ খ্যাতি অথবা ধন-সম্পদ উপার্জন করতে পারে। কিন্তু তা কখনোই তাঁকে আত্মার প্রশান্তি দিতে পারে না। অর্থাৎ সে সুখী হতে পারে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “কখনো সে সকল বস্তুর দিকে থাকা তাকাবে না যা আমি দুনিয়া পূজারীদের জন্য দিয়েছি। এসব দিয়ে আমি তাদের মাত্র পরীক্ষাই করি। বস্তুত! আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকই সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে স্থায়ী।” [সুরা তা-হা : ১৩১]
আল্লাহ কর্তৃক তাঁর বান্দাদের জন্য কিছু দুঃখ প্রেরণ করা। হতে পারে কাউকে হারানোর দুঃখ, খিদার দুঃখ, বা সম্পদ হননের দুঃখ। এরকম সকল বিষাদময় অবস্থা একচুয়ালি আল্লাহ কর্তৃক পরিক্ষা। আল্লাহ তাঁর ঈমানদার বান্দাদের পরিক্ষা নেন তাঁর ঈমানকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই আমি তাদের (মু’মিনদের) পরিক্ষা করবো ভয়, ক্ষুদা, সম্পদ ও তার জিবিন দ্বারা। ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।” [সুরা বাক্বারাহ:১৫৭] কি সুন্দর কথা! সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ কর্তৃক এ পরিক্ষায় যে বা যারা উত্তীর্ণ হবে তাদের সু সংবাদ দেওয়ার কথা আল্লাহ বলেছেন। আর আল্লাহ কর্তৃক সু সংবাদ কি হতে পারে? নিশ্চয়ই ‘জান্নাত’।
সহিহ বুখারির একটি হাদিসে বর্ণিত আছে যে, “মু’মিনের অবস্থা বড়ই বিস্ময়কর!! সবকিছুই তার জন্য কল্যাণ জনক। মু’মিন ছাড়া এই কল্যাণ আর কেউ লাভ করতে পারে না। মু’মিনের জীবনে যদি সুখ আসে, তাহলে সে আল্লাহর শোকর আদায় করে। আর সকল তার জন্য কল্যাণ ডেকে আনে। আর যদি তার জীবনে দুঃখ নেমে আসে তাহলে তাহলে সে সবর করে। সবর ও তার জন্য কল্যাণকর।”
মু’মিন আল্লাহর দেওয়া সুখ যেমন আনন্দচিত্তে গ্রহণ করে ঠিক সেরকম সে আল্লাহ প্রদত্ত দুঃখ ও গ্রহণ করে। মাথা পেতে দেয় মহান রবের সিদ্ধান্তের উপর। যিনিই তার পালনকর্তা। এতে সে বিপদের মাঝেও সুখ খুঁজে পায়।
ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ:) বলেন, “আমি আল্লাহ তা’য়ালার সিদ্ধান্তের উপর অবিচল থাকি এবং তা-ই মেনে নেই” আর তাতেই রয়েছে মু’মিনের আত্মিক প্রশান্তি।
দুনিয়া আর মরুভূমির মরীচিকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। নিছক খেল তামাশা নামক এই দুনিয়ার পিছনে আমরা অবলীলায় ছুটছি। দুনিয়াকে প্রাপ্তির লক্ষ্যে শত সহিষ্ণুতা বরণ করতেও প্রস্তুত। অথচ ঘন ধোঁয়াশা এই দুনিয়া। আবছা আলোর নিছক খেলা এই দুনিয়া। দুনিয়ার কোথাও, সুখ নেই। প্রশান্তি নেই। প্রশান্তি তো তাঁর পরশে। যিনি তোমাকে লালন পালন করেন। যিনি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁর ছোঁয়াই ‘সুখ’। এই দুনিয়ার জিবন নিছক খেল তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। [সুরা আনয়াম:৩২]
‘ প্রস্ফুটন গোলাপেও সুখ পাবে
যদি তাকে সে চাহনি তে রবের রহমত’