চারদিক অন্ধকার। মানবতার মুক্তির দাওয়াত আজ কেউ গ্রহণ করে না। মুক্তির দিশাও জানে না। সবাই হতাশ! সবাই হতাশ! বর্তমান বাংলাদেশও সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভূখণ্ডের প্রতীক। এহেন পরিস্থিতিতে আশার বাতিঘর হিসাবে দেখতে পাচ্ছি আগামীর ‘ক্বিবলাগাহী ঘরগুলিকে’।
দিনশেষে সূর্যের শেষ আলোকরশ্মির সাথে রাত্রির মিলন যেমন এক চিরসত্য, তেমনই এক সত্য মানবসভ্যতার চিরন্তন গঠনমুখী প্রবণতা। চিরকালই ব্যক্তি মানবসমাজের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় চরিত্রায়িত হয়ে আসছে। কারণ ব্যক্তি হচ্ছে মানবসমাজের ক্ষুদ্রতম একক। ব্যক্তিকে পরিবর্তন করার অর্থই হচ্ছে মানবসভ্যতার পরিবর্তনের সূচনা। আবার ব্যক্তির পরিবর্তনের জন্যও সমাজ, সভ্যতার পরিবর্তন জরুরি। দুটোর সমন্বয় ব্যতীত কোনভাবেই পরিবর্তনের কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর সমাজের গঠনমুখী প্রবণতার দরুন ব্যক্তিকে পরিবর্তনের মাধ্যমেই সামাজিক পট পরিবর্তনের ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। কারণ ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা এর গঠনপ্রক্রিয়া চিরন্তন।
ব্যক্তির কেন্দ্রীয় অবস্থানের দরুন প্লেটো তো রাষ্ট্রকেও ব্যক্তির বৃহৎ প্রতিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার এই ব্যক্তি গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা রাখে পরিবার। এ কারণে ইতিহাসে মানবের সূচনাও হয়েছিলো পরিবারের মাধ্যমেই, তাই পারিবারিক ব্যবস্থার গুরুত্ব এতো বেশি। এক্ষেত্রে পারিবারিক প্রভাব ব্যক্তির চিন্তা, আচার, মূল্যবোধ তথা ব্যক্তিত্ব গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা রাখে। এভাবেই চক্রাকারে এই গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সামগ্রিকতা ও সামষ্টিকতা নির্ভর হওয়ার কারণে ইসলাম পরিবারকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে। কুরআনে সূরা তাওবা, সূরা তাগাবুন, সূরা ইউনুস, সূরা ফুরকান ও তাহরীমসহ বহু স্থানে পরিবারের আলোচনা এসেছে। এহেন গুরুত্ব প্রদানের ফলে ইসলামী সভ্যতার ১২০০ বৎসরের ইতিহাসে পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তি ছিলো সুদৃঢ় ও সুসংহত। প্রতিটি পরিবার ছিলো জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত। রাষ্ট্রীয় গণনায়ও যেখানে শিক্ষার হার ছিলো শতভাগ।
তৎকালীন সময়ে জ্ঞানী ও মুজাহিদ পিতার সাথে-সাথে সকল মায়েরাও ছিলো যোগ্য আলেমা, সুশিক্ষিতা। যার ফলে ঘরগুলো ক্বিবলামুখী হিসেবেই গড়ে উঠতো। আর এ ঘর থেকে যে যুগশ্রেষ্ঠ মুজাহিদরাই উঠে আসবে তা বলা বাহুল্য। এ কারণেই ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে কখনোই কমতি হয়নি ইমাম আবু হানীফা, ইবনে সিনা, আল ফারাবী, গাজ্জালী, ইবনে খালদুনদের। কখনই অভাব হয়নি মুসা বিন নুসায়ের, মুহাম্মদ বিন কাসিম, বদর বিন মুগীরা, সালাহউদ্দীন আইয়্যুবীদের। হাজারো মুজাহিদ যে সভ্যতায় আলোবিকিরণ করতো, বাস্তবিকভাবেই সে সভ্যতার পতন ছিলো অসম্ভব।
পাশ্চাত্য সভ্যতা তার উত্থানযুগেই বুঝেছিলো, মুসলিমদের পরিবার প্রথায় ভাঙ্গন ধরাতে না পারলে কোনভাবেই ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি দুর্বল করা সম্ভব না! মুসলিমদের এই ঐক্যবদ্ধতা তাদের একগ্রচ্ছ শোষণের পথে বাধা স্বরূপ। হান্টিংটনের Clash of Civilization তত্ত্বের যুগে পশ্চিমা সভ্যতা ও ব্রিটিশ জায়নবাদের সামনে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিমদের পারিবারিক বন্ধন।
১৯৯৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “পাশ্চাত্যের ক্ষমতাসীন দুনিয়ায় পাশ্চাত্যের আগ্রাসন মুসলিম দেশগুলোতে সর্বজনীন না হওয়ার একমাত্র কারণ সাংস্কৃতিকভাবে মুসলিমদের পরিবারগুলোর একত্ব ও দৃঢ় পারিবারিক ভিত্তি”।
তাই, ব্রিটিশ জায়নবাদ বর্তমান পরিবারপ্রথাকে মনে করছে সর্বনাশা হুমকি। এ কারণে পশ্চিমা/হিন্দুত্ববাদী মিডিয়াগুলি পরিবারের উপর হানছে তীব্র আঘাত। পারিবারিক জীবনে রূহানী বন্ধনকে অস্বীকার করে এক ধরণের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী প্রবণতার বিকাশ ঘটাচ্ছে। যার ফলেই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই পারিবারিক বলয় থেকে আলাদা করে ফেলছে নিজেকে। এতে সবাই হয়ে যাচ্ছে পরিবারবিমুখ, দুর্বল হয়ে পড়ছে পরিবারের ভিত্তিগত গঠন।
সাথে-সাথে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় সফলতা মুসলিম পরিবারের বাবা, মায়েরাও সেই চেতনাসম্পন্ন মুজাহিদ, প্রজ্ঞাবান রাহবার তৈরির স্বপ্ন দেখেনা, সন্তানের মাঝে স্বপ্ন বুনেও না! সেভাবে লালনপালন পদ্ধতিও জানেনা! শুধু জানে কিভাবে বস্তুবাদী রেইসে প্রতিযোগিতা চালাতে হবে, কথিত পুঁজিবাদী সফলতা আনতে হবে।
বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার আধ্যাত্মিকতাবিহীন দর্শন গোটা মানবসমাজকে দূষিত করে ফেলছে। কিন্তু চোখধাধানো প্রযুক্তিতে অগ্রসর ইউরোপ ও পারিবারিক প্রথা ভেঙ্গে পড়ায় এক ধ্বংসোন্মুখ সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। যেখানে লক্ষ লক্ষ ডলার বিলিয়ে সন্তান নিতে উৎসাহিত করা হয়, বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা যেখানে বেড়েই চলছে, যেখানে পরিবার ব্যবস্থা টিকে থাকাটাই অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ইউরোপে আজ শুরু হয়েছে এক নীরব কান্না, বস্তুবাদী এ সভ্যতা আবার পরিবারের সেই সুশীতল বন্ধনে আশ্রয় নিতে চায়। হাজারো চেষ্টা বস্তুবাদী জীবনপ্রণালীতে তারা খুঁজে পাচ্ছেনা আত্মিক শান্তি।
সে ব্যর্থতার দায়শোধে মিডিয়া আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলিম পরিবারগুলোর উপর আঘাত হানছে। যার ফলে পারিবারিক কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, পরকীয়ার মত অসংখ্য সংকট আমাদের পরিবারগুলোকেও আচ্ছন্ন করে ফেলছে। যেমন: হিন্দি সিরিয়াল গুলোর কথাই ধরা যাক, এর জন্য যে কত পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এর ন্যায় একটা ভয়াবহ সংকট আমাদের সামনে থাকা সত্তে¡ও আমাদের যেনো কোন ভ্রূক্ষেপই নেই !! আমাদের অবহেলা আর তাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের তীব্র প্রভাব আমাদের গোটা সমাজকে, অ লকে প্রভাবিত করছে। যাতে প্রাণহীন হয়ে পড়ছে আমাদের পরিবার। যে পরিবার থেকে তৈরি হচ্ছে উদ্যমহীন, হতাশ এক প্রজন্ম।
বাস্তবিকভাবেই এ পরিবারগুলো থেকে সভ্যতা বিনির্মাণের মহা কঠিন কাজ আঞ্জাম দেওয়া অসম্ভব। কারণ মানুষের প্রাথমিক বয়স তথা যে বয়সটা তাকলীদের (অনুকরণ) সময় সে সময়টার সিংহভাগই সে কাটায় পরিবারের সাথে। সে সময়ের স্মৃতি, কাজ পরবর্তী জীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। যার কারণে পারিবারিক বলয়ের গুরুত্ব এতো বেশি। যুগে যুগে যারাই/যে সকল মনীষীরা এ ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন, পারিবারিক প্রভাবের এক বিশাল ছোঁয়া ছিলো তাদের জীবনে। গত শতাব্দীতে যারা ইসলামী পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তথা আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদূদী, আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ, আলী শরীয়তী, আবুল হাসান নদভীরা পারিবারিক শিক্ষা থেকেই উঠে এসেছেন।
যেমন: আল্লামা ইকবালের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, পারিবারিক শিক্ষা, পিতার সুফী জীবনধারণ এবং মায়ের ব্যক্তিত্ব তাঁর পরবর্তী জীবনে বিশাল প্রভাব রেখেছিলো। এভাবে আবুল হাসান নদভী, আলী শরীয়তীদের জীবনেও পরিবারের বিশাল প্রভাব ছিলো। পরিবার থেকেই তারা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
বাস্তবতা হলো আখলাকবিহীনতার মতো ভয়াবহ সংকট সৃষ্টিতে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়-ই মূল ভূমিকা রেখেছে-
- বস্তুবাদী জীবনধারণ।
- আখলাকবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা।
- ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। যা এক নীরব ঘাতক হয়ে পরিবারের উপর আঘাত হেনেছে।
উপরন্তু আর্থ-সামাজিক অবস্থার জাহেলী প্রভাব তো আছেই। এভাবে অদৃশ্য সমস্যার এক বিশাল থাবা গ্রাস করে ফেলছে আমাদের পরিবারগুলোকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে কতো পরিবার! মা-বাবা যখন আস্থাস্থল হতে পারছেনা তখন স্বপ্ন, চাহিদা, সমস্যা শেয়ার করতে না পেরে বখাটে হয়ে যাচ্ছে কতো সম্ভাবনাময়ী সন্তান। দাম্পত্যকলহের কারণে পরকীয়ায় জড়াচ্ছে কতজন! সার্বিকভাবে ভাইরাসের ন্যায় এ সমস্যা গ্রাস করে ফেলছে আমাদের সমাজব্যবস্থাকে।
এ অবস্থা শুধু ইলমবিহীন অজ্ঞ লোকদের ক্ষেত্রেই নয়, ইসলামী আন্দোলনে জড়িত বহু পরিবারেও এমন হাজারো সংকট। বাহিরে আখলাকের বয়ান দিয়ে ঘরে ফিরে স্ত্রীর সাথেই দুর্ব্যবহার! বহু জায়গায় অবদান রাখছে, অথচ সময়ই নেই নিজের পরিবারের খবর নেওয়ার! এ বিষয়টি আলাদাভাবে বলার কারণ হচ্ছে- অন্য দশটা পরিবারের চেয়ে এসকল মানুষদের সন্তান দায়ী, প্রজ্ঞাবান, মুজাহিদ হলে অনেক বেশি কাজ ও ফলাফল বয়ে আনা সম্ভব। সারা পৃথিবীর বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও অন্তত পরিবারের সমর্থন পাবে আজীবন। উদাহরণ স্বরূপ: হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে যতটা না বাধার মোকাবেলা করতে হয়েছে, ইসমাইল (আ.) কে তার চেয়ে কম বাধার মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। কারণ নমরূদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে ইব্রাহীম (আ.) এর পিতাই তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিলো। অপরপদিকে ইসমাইল (আ.) সর্বাত্মকভাবে তাঁর পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
আবার ইউসুফ (আ.), ইয়াহইয়া (আ.) এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তাদের পরিবারও ছিলো ক্বিবলামুখী। যার ফলে নবুওয়াত পাওয়ার পূর্বেই অনেক বেশি উন্নত মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। এ কারণেই নবীরা সন্তান চাইতেন যাতে তারা তাদের অসমাপ্ত কাজকে পরিপূর্ণতা দিতে পারেন। মিশনকে সম্পন্ন করার জন্যই নবীরা বংশ পরম্পরায় দায়িত্ব পালন করতেন। এ জায়গাতেই পরিবারকে ক্বিবলামুখী করার গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ঘরকে ক্বিবলাগাহী করা এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা সম্ভব হলে ইসলামী পুনর্জাগরণী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো অনেকাংশেই কমে যায়।
ব্যক্তি ও পরিবার যদি ব্যাপকভাবে ইসলামমুখী হয়ে ওঠে তাহলে সমাজজীবনে ইসলাম আদর্শ বাস্তবায়নের প্রাথমিক ভিত্তি মযবুত হয়। সেজন্যই পরিবারকে ইসলামমুখী করার বিকল্প পন্থা আমাদের হাতে নেই। কারণ যতগুলি পরিবার ক্বিবলাগাহী হবে, ক্বিবলামুখী মুজাহিদদের সংখ্যা ততোই বৃদ্ধি পাবে। তাইতো ইমাম হাসান আল বান্না আত্মশুদ্ধি ও ক্বিবলাগাহী ঘরের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন “যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মধ্যে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে পারবোনা, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রে খেলাফত প্রতিষ্ঠা অসম্ভব”।
কারণ এসকল ইসলামমুখী ঘরগুলোর সাহায্যেই একটি আদর্শ সমাজ দাঁড়িয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী (র.) এর দেওয়া দারুল ইসলাম ট্রাস্ট তত্ত্বের উদ্দেশ্যও এটাই। ট্রাস্ট তত্ত্বের মূলকথা হচ্ছে-“প্রতিটি ঘর ক্বিবলামুখী হবে। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে এমন একটি উন্নততর সমাজব্যবস্থার মডেল দেখতে পায় যার প্রভাবে তারা মুজাহিদ হিসেবে বেড়ে উঠবে। এবং গোটা দুনিয়াকে, সভ্যতাকে ইসলামীকরণের প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হবে।”
এ লক্ষ্যেই ঘরগুলোকে সেভাবে তৈরি করা কর্তব্য। এর জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সমাজকে সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা চালানো।
ইসলামী সভ্যতার ঘরগুলোর গুরুত্বের কারণে এলাকাগুলোও তৈরি হতো সুপরিকল্পিতভাবে। এটি ছিলো এ সভ্যতার অন্যতম অসাধারণত্ব। এলাকাগুলো তৈরি হতো মসজিদকে কেন্দ্র করে। মসজিদ ছিলো একইসাথে লাইব্রেরী ও ইন্সটিটিউট। এলাকার মধ্যে কোন বাজার ছিলো না। বাজার থাকতো এলাকার একেবারে শেষ প্রান্তে। কোলাহলমুক্ত, শান্ত পরিবেশের বিরাট প্রভাব পড়তো নতুন প্রজন্মের উপর। এমন সমাজে কোন সুযোগই ছিলোনা পর্দাহীনতার। ঘরে ঘরে ছিলো আখলাকের বয়ান।
নগরায়নের এক বিরাট প্রভাব যে মানুষের মনের উপর পরে তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বলেছেন উস্তাজ তুরগুত জানসেব: “তুমি যদি কোন শহরে কেমন মানুষ গড়ে উঠবে তা চিন্তা না করেই শহর গড়ে তোলো, তাহলে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নেবে যারা তোমার গড়ে তোলা শহরকে ধ্বংস করে দেবে”।
বর্তমানের অসভ্য নগরায়নের ফলে ঘরের ভেতরই শিখতে হচ্ছে লজ্জাহীনতা। মা-বোনদের সাথে প্রাইভেসি রক্ষা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে নবজাত মন-মানস। সার্বিকভাবে এই আগ্রাসন প্রতিরোধের একমাত্র দৃশ্যমান উপায় হচ্ছে সিস্টেম। কিন্তু ব্যক্তি তৈরি না হলে সিস্টেম তো বহুদূর। আর যোগ্য ব্যক্তি তৈরি করতে হলে ঘরকেও সেভাবে তৈরি করতে হবে, ক্বিবলাগাহী করতে হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই, বর্তমান সময়ে ব্রিটিশ জায়নবাদের আগ্রাসন মোকাবেলার একমাত্র উপায় হচ্ছে ক্বিবলাগাহী ঘর তৈরি করা।
এ বিষয়ের গুরুত্ব আরো ভালোভাবে বুঝা, বর্তমান সময়ের সংকট মোকাবিলা ও ব্রিটিশ জায়নবাদকে মোকাবেলা করার জন্য আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো এ আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে হলে ফিরাউনের বিরুদ্ধে হযরত মূসা (আ.) এর সংগ্রাম বুঝা আবশ্যক। কারণ আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা সে ফিরাউনী সভ্যতারই সন্তান।
হযরত মূসা (আ.) যখন “আল্লাহর নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব” ঘোষণা করলেন তখন ফিরাউন আতংকিত হয়ে তার সভাসদদের বলেছিলো: “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করবো। সে তাঁর রবকে ডাকুক। আমি আশঙ্কা করি সে তোমাদের জীবনব্যবস্থা বদলিয়ে দেবে (অন্ততপক্ষে) দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” (সূরা মু’মিন-২৬)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায় তখন ফিরাউনের সাথে মূসা (আ.) এর সংগ্রামের এক চূড়ান্ত পর্যায় চলছিলো। যার ফলে ফিরাউন মূসা (আ.) কে থামানোর জন্য তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে। এমনই এক সময় আল্লাহ মূসা (আ.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: وَٱجْعَلُواْ بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلاَةَ وَبَشِّرِ ٱلْمُؤْمِنِين “তোমাদের ঘরগুলোকে বানাবে ক্বিবলামুখী করে, আর সালাত কায়েম করো ও ঈমানদারগণকে সুসংবাদ দান করো”। অর্থাৎ তোমাদের ঘরগুলোকে বিপ্লবের ঘাটিতে রূপান্তর করো। বিপ্লবের ভ্যানগার্ড তৈরি করো। সভ্যতা বিনির্মাণের ক্বিবলামুখী মুজাহিদ এ ঘর থেকেই উঠে আসবে। এ আয়াতে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়।
প্রথমত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘরকে ক্বিবলামুখী করে গঠন করতে বলেছেন। যেখানে মুজাহিদ তৈরি হবে। ঘরকে সেভাবে গঠন করা বিপ্লবের প্রথম শর্ত। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হলে ঘর পরিবর্তন করা যে আবশ্যক তা এ আয়াত থেকে সহজেই বুঝা যায়। কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে সেখানে নতুন ব্যবস্থার বুনিয়াদ নির্মাণ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি কাজ। তাই এ মহা দায়িত্ব যারা পালন করবে তাদেরকে নবী-রাসূল, ও সাহাবাদের উত্তরসূরি হিসেবেই তৈরি হতে হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর এ শিক্ষার বয়ান শুরু হবে পরিবার থেকেই।
দ্বিতীয়ত, সালাত কায়েম করা। কারণ সালাত শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয় বরং ইসলাম কিভাবে বিশ্বব্যবস্থাকে পরিচালনা করতে চায় তারও প্রতীক। সালাতের ক্ষেত্রে ঘটেছে বুদ্ধিবৃত্তি ও আধ্যাত্মিকতার এক অসাধারণ সমন্বয় যা মানুষকে পরিবর্তন করতে যথেষ্ট। এমনকি সালাতের মধ্যে সামরিক ট্রেনিংয়েরও সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। তাই এখানে সালাত স্রেফ মসজিদে গিয়ে ইবাদত নয় বরং দৈহিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যকেও নির্দেশ করে।
তৃতীয়ত, মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দেওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, যদি এ দুটি শর্ত পূরণ করতে পারো তাহলে সাফল্য সুনিশ্চিত। আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে বড় জায়গাও এটি। আর ঘরকে ক্বিবলামুখী করার মর্মার্থ হলো, এমন একটি ঘর তৈরি করা যেটি হবে বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি ও বিশ্বাসের জীবন্ত প্রতিবিম্ব মুজাহিদেরা তৈরি হবে। অতএব এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাইয়্যেদ কুতুব তার ‘ফি যিলালিল কুরআন’ এ বলেছেন, ‘ক্বিবলা শুধু নামাযের দিকের নাম নয়, বরং ক্বিবলা হচ্ছে বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। নিজস্ব চিন্তাধারা, পরিচয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রতিটি বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে ক্বিবলা’।
তিনি সামনে অগ্রসর হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ প্রদত্ত খোদায়ী ব্যবস্থার নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করলেই বুঝা যায় তিনি তার ক্বিবলমুখী বান্দাদেরকেই সভ্যতার উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। প্রতীকী এ ক্বিবলা অনুসরণের মাধ্যমে উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি মানুষের মনে যেনো এ কথাটি বদ্ধমূল হয়ে যায়, তারা একই লক্ষ্য, একই জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত’। এ ঐক্য যেনো উম্মাহর প্রতিটি সদস্যকে একীভূত করে একক সত্তা গঠন করে এবং আগামীর মুজাহিদেরা যাতে ন্যায়ভিত্তিক নতুন দুনিয়া গঠনে অগ্রসর হয় সেজন্য ঘরকে, পরিবারকে তৈরি করতে হবে আখলাকী বলয়ের ভেতরে, ক্বিবলাগাহী করে।
১৯৯৬ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে যখন ‘পোস্ট মডার্ন ক্যু’ এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখন তাঁর ভোট ছিলো সর্বোচ্চ। তিনি যদি আন্দোলনের ডাক দিতেন তাহলে তুরস্ক উত্তাল হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি, সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। যুবকেরা যখন তার কাছে ছুটে এসেছিলো, তখন তিনি বলেছিলেন, “হে যুবকেরা, ফিরে যাও। নিজেদের ঘরকে ক্বিবলামুখী করো। বিপ্লবের ঘাটি হিসেবে তৈরি করো। সেখান থেকে যেনো আগামীর প্রজ্ঞাবান মুজাহিদেরা উঠে আসে”।
তুরস্কে গণ-আন্দোলন করার সামর্থ্য থাকা সত্তেও হোজা এরবাকানের এ কথা বলার কারণ ছিলো, ঘর যদি গঠন না হয়, আন্দোলনমুখী না হয়, তাহলে বিপ্লব করা প্রায় অসম্ভব। কারণ শুধু বিপ্লবী জমিন তৈরির জন্য নয় বরং বিপ্লব স্থায়ী রাখার জন্যও ঘরকে তৈরি করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যে ঘর থেকেই এ পুনর্জাগরণের সূচনা, সংকটকালে সে ঘরকেই দুর্গের ভূমিকা পালন করতে হবে। আবার বিপ্লবের জন্য যে জানবাজ প্রজ্ঞাবান আলেম দরকার, মুজাহিদ দরকার (ক্বিবলাগাহী ঘর ব্যতীত যাদের তৈরি হওয়া অসম্ভব) তা না হলে জাহেলী ব্যবস্থার পতন কোনভাবেই সম্ভব না। কারণ সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী মুজাহিদেরাও পরিবার থেকে উঠে আসবে। সুতরাং পরিবার ইসলামমুখী হওয়ার মাঝেই সাফল্যের চাবিকাঠি। মুজাহিদেরা তৈরি না হলে নতুন দুনিয়া গঠন কল্পনায়ই থেকে যাবে।
যেমনটা বলেছিলেন মাওলানা মওদূদী- “পরিবার হলো ইসলামী সভ্যতার শেষ দুর্গ। ইসলামী সভ্যতা তার সংকটকালে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। ঘর জাহেলী হলে সেখানেই তার পতন হয়। আর ঘর যদি ইসলামমুখী হয়, তাহলে ঘর থেকেই আবার পুনর্জাগরিত হয়ে ওঠে”।
মুসলিম বিশ্বে পারিবারিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করার এই সময়ে মনীষীগণ তাই বলছেন, ‘ঘরকে ক্বিবলাগাহী বানাও। কারণ নিজেরা শক্তিশালী না হলে, যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব উঠে না আসলে কখনোই নতুন সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই সেই প্রজ্ঞাবান মুজাহিদ তৈরি, ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণ শুরু হবে এই ক্বিবলাগাহী সুশীতল পারিবারিক ভিত্তির মধ্য দিয়েই’ ইনশাআল্লাহ।