“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।”
কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতাটি আমরা সবাই জানি। তিনি চেয়েছিলেন মসজিদের পাশে যেনো তার কবর দেওয়া হয়। কেনো? যাতে তিনি মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পান, মুসল্লিদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পান। নজরুলের এই কবিতা পড়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে- মৃতরা কি কবরে শুয়ে শুয়ে কিছু শুনতে পায়? আমরা আজকে সেটা নিয়ে আলোচনা করবো, ইন শা আল্লাহ।
সাহাবীদের মধ্যে আকীদার বিষয়ে তেমন মতপার্থক্য ছিলো না বললেই চলে। আকীদার ক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকটি প্রশ্নে সাহাবীরা মতপার্থক্য করেছেন। তারমধ্যে টপ অব দ্যা লিস্টে থাকবে এই প্রশ্নটি- মৃতরা শুনতে পায় কিনা? সাহাবীদের মধ্যে এই প্রশ্নে দুটো মত ছিলো। একটি মত হলো- মৃতরা শুনতে পায়, আরেকটি মত হলো- মৃতরা শুনতে পায় না। প্রথমে আমরা দেখবো, কুরআন এই সম্পর্কে আমাদেরকে কী বলছে।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“নিশ্চয় তুমি মৃতকে শুনাতে পারবে না, আর তুমি বধিরকে আহ্বান শুনাতে পারবে না, যখন তারা পিঠ ঘুরিয়ে চলে যায়।” [সূরা আন-নামল- ২৭:৮০]
“আর জীবিতরা ও মৃতরা এক নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শুনাতে পারেন, কিন্তু যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে তুমি শুনাতে পারবে না।” [সূরা আল-ফাতির- ৩৫:২২]
যারা বলেন ‘মৃতরা শুনতে পায় না’ তাঁদের প্রাথমিক প্রমাণ হলো কুরআনের এই দুটো আয়াত। আল্লাহ কুরআনে স্পষ্ঠভাবে বলছেন- তুমি মৃতকে শুনাতে পারবে না। এখন আমরা দেখবো হাদীসে কী আছে। বদর যুদ্ধ শেষে কাফিরদের লাশগুলোকে দাফন করা হয়। লাশ দাফন শেষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফিরদের নামধরে ডাকতে থাকেন। নামধরে ডেকে তিনি সূরা আরাফের ৪৪ নাম্বার আয়াত তেলাওয়াত করেন-
“তোমাদের সাথে রব যে ওয়াদা করেছেন, তা তোমরা বাস্তবে পেয়েছো?”
এটা দেখে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বেশ অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি মৃতদেরকে ডেকে কথা বলছেন?” অর্থাৎ, তারা তো মৃত। আপনি তাদের সাথে কিভাবে কথা বলছেন? উমরের (রা:) প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন (ভাবানুবাদ),
“তোমরা যেমন আমাকে শুনছো, তারাও ঠিক আমাকে শুনছে; কিন্তু তারা জবাব দিতে পারছে না।” [সহীহ বুখারী: ১৩৭০]
আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতোটুকু দূরে যায়, সে তখনো তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়।” [সহীহ বুখারী: ১৩৭৪]
তারমানে, হাদীস থেকে আমরা জানলাম- মৃতরা শুনতে পারে। যারা বলেন ‘মৃতরা শুনতে পায়’ তারা উপরিউল্লিখিত হাদীসগুলোকে রেফারেন্স হিশেবে ব্যবহার করে। এখন আমরা কিভাবে কুরআন এবং হাদীসকে Reconcile (পুনর্মিলন) করবো? আমরা প্রথমেই দেখবো, যারা বলেন ‘মৃতরা শুনতে পায়’ তারা কিভাবে কুরআনের ঐ দুটো আয়াতকে বুঝেছেন।
কুরআনের ঐ দুটো আয়াত আল্লাহ কাফিরদের প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে নাযিল করেছেন। অর্থাৎ, কাফিররা হিদায়াতের বাণী পাবার পরও শুনে না, ঠিক যেমনটা মৃতরা শুনে না। এখানে ‘শোনা’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে? এখানে শোনাটা হলো Beneficial-Guidance বা উপকারী অর্থে। ‘কাফিররা শুনে না’ মানে তারা আক্ষরিকভাবে শুনে না, এমন না।
যেমন: আল্লাহ সূরা বাকারায় কাফিরদের সম্পর্কে বলেছেন-
“তারা বধির-মূক-অন্ধ। তাই তারা ফিরে আসবে না।” [সূরা বাকারা- ২:১৮]
তার মানে কি কাফিররা আক্ষরিক অর্থে বধির-মূক-অন্ধ? না, তারা আক্ষরিক অর্থে বধির-মূক-অন্ধ না। তারাও শুনতে পায়, দেখতে পায়, কথা বলতে পারে। এখানে অন্ধত্ব, বধিরতা বলতে বুঝানো হচ্ছে Spiritual অন্ধত্বের কথা। অর্থাৎ, তারা হেদায়াতের আলো পায় না, হেদায়েতের আলো দেখে না, হেদায়াতের বার্তা শুনে না।
আল্লাহ কুরআনে বলেন:
“চোখ তো অন্ধ হয় না, অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।” [সূরা আল-হাজ্ব ২২:৪৬]
চোখ দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখেও যদি কেউ আল্লাহর উপর ঈমান না আনে, আল্লাহকে অস্বীকার করে তাহলে সে চোখ থাকাবস্থায়ও অন্ধ। আর এই অন্ধত্ব তার চোখের না; বরং হৃদয়ের। তো যারা বলেন ‘মৃতরা শুনতে পারে’ তারা কুরআনের দুটো আয়াতকে ব্যাখ্যা করে- মৃতরা শুনতে পারে না মানে মৃতদের শুনাটা তাদের কোনো বেনিফিট দেয় না; যেমনটা কাফিরদের শুনতে পারাটা তাদের হেদায়াত দিচ্ছে না।
মৃতরা শুনতে পারে- এই মতে পক্ষে কোন কোন সাহাবী, ইমামগণ আছেন আমরা তাঁদের লিস্ট দেখবো:
-
উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
-
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
-
আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
-
আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
-
ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনে হাজম (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম আশ-শানকিতী (রাহিমাহুল্লাহ)
অর্থাৎ, সাহাবীদের মধ্যে বড়ো একটা অংশ এবং অনেক জায়ান্ট স্কলাররা এই মতপোষণ করতেন।
এবার আমরা দেখবো ‘মৃতরা শুনতে পারে না’ এই মত যারা পোষণ করতেন তারা ঐ হাদীসগুলোকে কিভাবে ব্যাখ্যা করতেন।
বদরের মৃতদের হাদীসকে তারা ব্যাখ্যা করেন এভাবে: উমর (রা:) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তারা তো মৃত। তারা কি আপনার কথা শুনছে?” অর্থাৎ, উমর (রা:) জানতেন যে, মৃতরা কথা শুনতে পায় না। তাঁর প্রশ্নের জবাবে কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে সংশোধন করে বলেননি- “ও উমর! তুমি কি জানো না যে, মৃতরা কথা শুনতে পারে?” বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তোমরা যেমন আমার কথা শুনছো, তারাও এখন আমার কথা শুনছে।” অর্থাৎ, ঐ ঘটনাটি ছিলো একটা Exception.
বিশিষ্ট মুফাসসির কাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বদরের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন-
“আল্লাহ ঐ সময় কাফিরদেরকে আবার জীবন দান করেছিলেন যাতে তারা নবীর কথা শুনতে পায়।”
দাফন করার পর পায়ের আওয়াজ কবরবাসী শুনতে পায়, এই হাদীসকে তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, মুনকার-নাকীরের প্রশ্নোত্তর পর্ব পর্যন্ত মৃতরা জীবিতদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে পর্দা ফেলে দেওয়া হয়, মৃতরা আর শুনতে পায় না।
আর নবীর উপর দুরূদ পড়া হলে ফেরেশতারা সেটা নবীর কাছে নিয়ে যায়, এটা হলো শুধুমাত্র নবীর জন্য। এটাও Exception, Rule of Thumb না। ‘মৃতরা শুনতে পায় না’ এই মতপোষণ করতেন উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। আয়িশাকে (রা:) যখন বদরের ঘটনাটি বলা হলো, তখন তিনি কুরআনের দলীল দিয়ে বললেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) ভুল বুঝেছেন। [সহীহ মুসলিম: ২০৪৩] যারা ‘মৃতরা শুনতে পায় না’ মতপোষণ করতেন তাঁদের লিস্টটিও কিন্তু যেনতেন না। তাঁদের লিস্টেও সাহাবী, তাবেঈ, বড়ো বড়ো ইমামগণ আছেন। যেমন:
-
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)
-
কাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম বায়হাকী (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনে আতিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনে কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনুল গুমাম (রাহিমাহুল্লাহ)
-
ইমাম ইবনুল আবেদীন (রাহিমাহুল্লাহ)
-
নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)।
বিখ্যাত হানাফী স্কলার আল্লামা নোমান আল-আলূসী একটা বই লিখেন এবং প্রমাণ করেন- হানাফী মাজহাবের আকীদা হলো মৃতরা শুনতে পায় না। বইটিতে তিনি বড়ো বড়ো হানাফী স্কলারকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন [লিংক কমেন্টে]। হানাফী মাজহাবের মধ্যেও অনেকগুলো স্কুল অব থট আছে, যেমন হানাফী মাজহাবের ইন্ডিয়ান স্কুল অব থট। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের হানাফী আলেমদের মত হলো- মৃতরা শুনতে পায়; যেমনটা উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু), ইবনে তাইমিয়ারা বলতেন। ইবনে তাইমিয়া (রাহি:) তাঁর বিখ্যাত ‘মাজামাউল ফাতওয়া’ তে লিখেন,
“মৃতরা শুনতে পায়।” রেফারেন্স হিশেবে তিনি সহীহ বুখারীর ১৩৭৪ নাম্বার হাদীসটির উল্লেখ করেন। [মাজামাউল ফাতাওয়া: ৪/২৭৩]
তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমও (রাহি:) একইমত পোষণ করতেন। তাঁর বিখ্যাত ‘কিতাবুর রূহ’ গ্রন্থে তিনি লিখেন,
“মৃতরা জীবিতদেরকে শুনতে পায়, তাদের সালাম শুনতে পায় এমনকি সালামের জবাবে মৃতরাও সালাম দেয়।” [কিতাবুর রূহ: ১৪১]
আমরা দেখলাম, দুই দলের স্বপক্ষে দলীলও আছে, যুক্তি, পাল্টাযুক্তিও আছে। তাহলে আমরা কোনটা মানবো? এখানে আমি প্রথমে উল্লেখ করতে চাই আন্দালুসের একজন মুফাসসিরের উক্তি। তাঁর নাম ইবনে আব্দুল বা’র (রাহিমাহুল্লাহ)। তাঁকে এই প্রশ্নটি করা হলে তিনি বলেন,
“মৃতরা শুনতে পায় কি পায় না এটা আমরা মারা যাবার পরই দেখতে পারবো, এর আগে নয়।”
তবুও আমাদের কৌতুহলী মন জানতে চায়। এক্ষেত্রে আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, মৃতরা শুনতে পাওয়া না পাওয়ার উপর কিন্তু আমাদের শরীয়তের কোনো হুকুম বদলে যাবে না। যারা বলেছেন ‘মৃতরা শুনতে পায়’ তারাও কিন্তু বলেননি যে, “কবরের পাশে গিয়ে মৃতের সাথে গল্প করা যাবে। পরীক্ষার রেজাল্ট হলে তাদেরকে জানানোর জন্য কবরে যাবো। দুনিয়ার খবরাদি তাদেরকে জানাতে যাবো।” অর্থাৎ, মৃতরা শুনতে পেলেও তাদের সাথে আমাদের ‘আচরণ’ কিন্তু বদলে যাবে না। আমরা কবরস্থানে গিয়ে তাদের কাছে চাইতে পারবো না- “অমুক, তুমি আল্লাহকে বলো আমাকে এটা দিতে।” কিংবা আমরা তাদেরকে গিয়ে বলতে পারবো না, “অমুক, তুমি আমাকে একটা পুত্র সন্তান দাও।” এরকম শিরকী কথা তো কক্ষণো বলা যাবে না।
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর সাহাবীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। যেসব সাহাবী ‘মৃতরা শুনতে পায়’ মতপোষণ করতেন তাঁরা কখনো নবিজীর রওজায় গিয়ে বলেননি, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে তো গৃহযুদ্ধ চলছে, আপনি আল্লাহকে বলে কিংবা আপনি একটু মীমাংসা করে দিন।” তাবেঈরাও সাহাবীদের কবরে গিয়ে এরকম কিছু চাননি। সুতরাং, ‘কবরবাসী শুনতে পায় কি পায় না?’ এই প্রশ্নে আমরা যেই আকীদাই পোষণ করি না কেনো, সেটা পৌঁছেছে সাহাবী, সালাফ পর্যন্ত। কিন্তু তাই বলে, আমরা কবরবাসীর কাছে কিছু চাইতে পারবো না।
[Barzakh সিরিজের ‘Can the dead hear?’ লেকচারের ভাবানুবাদ]