প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যেকোন সেনসেটিভ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার একটি স্থায়ী পর্যালোচনা হলো, এরকম বিষয়গুলোতে ইমিডিয়েট কোন সিদ্ধান্ত তিনি নেন না বরং সময় নিয়ে এটার পক্ষে জনমত তৈরী করেন এবং পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ক্রমান্বয়ে সবাই যখন এ ব্যাপারে সহনশীল হয় কিংবা বিরোধীতা বন্ধ করে তখন সিদ্ধান্ত নেন।
যেমন, হিজাব ইস্যু যদি বলি তাহলে এটা তুরস্কের ডানপন্থী সবারই সবচেয়ে সেনসেটিভ ইস্যুর একটি ছিল। এমন পরিবার খুবই কমই পাওয়া যাবে যারা কিনা হিজাব ইস্যুতে মাজলুম হন নাই বিশেষত শিক্ষিত লেভেলে। অনেক ছাত্রীর ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে, নির্যাতিতা হয়েছেন এবং অনেক মহিলার চাকুরী চলে গিয়েছে কিংবা সরকারী চাকুরী করতে পারেননি শুধু এই হিজাবের কারনে।
নির্যাতিতার এই সংখ্যাটা শতশত নয় বরং হাজার হাজার তথা অগণিত। স্বভাবতই এরদোয়ান ক্ষমতায় এসে পরেরদিনই আইন পাশ করিয়ে নিতে পারতেন। কেননা তখন একে পার্টির সংবিধান পরিবর্তন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ট এমপি ছিল। কিন্তু তা করেননি। ধীরে ধীরে হিজাব পড়ার ক্ষেত্রে যে আইনগত বাধাগুলো ছিল তা দূর করেছেন। তাও খুব আস্তে আস্তে। ধরুন, এ বছর হয়তো শিক্ষকদের হিজাব পড়া নিয়ে আইনগত বাধা দূর করেছেন, পরের বছর তা করেছেন ডাক্তারদের ক্ষেত্রে। এভাবে ধীরে ধীরে যখন সব বাধা দূর করেছেন তখন প্রথমবারের মতো চারজন এমপি পার্লামেন্টে ঢুকেছিল হিজাব পড়ে।
সেক্যুালার সিএচপিসহ কেউ ট্যু শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি কারণ ততদিনে সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই চারজনের এমপির মধ্যে একজনের সাথে আমি সিভিল সোসাইটিতে একসাথে কাজ করি। উনাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম । উনি বলেছিলেন, হাফিজ, কতটা কষ্ট লাগতো তা তুমি বুঝবা! সেই পারিবারিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিধান সব বাদ দিয়ে যখন পার্লোমেন্টে ঢুকতাম তখন হিজাব খুলে ঢুকা লাগতো। প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে ফজিলত পার্টির এমপি মেরভে কাভাকচিকে শপথ পড়তে দেওয়া হয়নি এবং পার্লামেন্ট থেকে অপমান করে বের করে দেওয়া শুধু এই হিজাবের কারণে।
এখন আসি আয়াসোফিয়ার ব্যাপারে। তুরস্কে ডান এবং ইসলামপন্থীদের অস্তিত্বের (সিম্বলিক) সবচেয়ে বড় একটি জায়গা ছিল আয়াসোফিয়া। এটাকে উসমানী তথা ইস্তান্বুল বিজয়ের নিদর্শন মনে করা হতো। আয়াসোফিয়াকে জাদুঘরে রুপান্তর করার সিদ্ধান্ত কখনই মুসলিম সেন্টিমেন্টের কেউই (এখানে মুসলিম নামধারীদের কথা বলছি না, বলছি মুসলিম চেতনা লালন করেন এমন মানুষদের কথা) মেনে নেয়নি।
আতাতুর্কের সময় থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, এটাকে মসজিদে পুন:রুপান্তের দাবী উঠেছে। তুরস্কে ইসলামী জাগরণের অন্যতম কবি নাজিব ফাজিল কিসাকোরেক (১৯০৪-১৯৮৩) বলেছিলেন, “হে যুবকেরা, আয়াসোফিয়া আজ হোক, কাল হোক (একদিন) খুলবে। কেননা, এই দেশ টিকে থাকবে কি থাকবে না এমন সন্দেহ যারা করে তারাই আয়াসোফিয়া খুলবে কি খুলবে না এমন সন্দেহ করে। আয়াসোফিয়া খুলবেই, আর এমনভাবে খুলবে যে, এই জাতির যারা ভালো চায় তার……।
তুরস্কের ডানপন্থী দলগুলো সর্বদাই আয়াসোফিয়াকে মসজিদে পুন:রুপান্তরের পক্ষে ছিল। বিশেষ করে এখানকার ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের এ ব্যাপারে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। দীর্ঘদিন আয়াসোফিয়ার পক্ষে মানুষকে জাগিয়েছেন, দাবী তুলেছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ১৯৯৪ সালে ইস্তান্বুল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “আয়াসোফিয়া মুসলমানদের জন্য পুন:রায় মসজিদে রুপান্তরিত হবে।”
প্রসঙ্গত, কামালিস্ট এবং সেক্যুলার দলগুলো সর্বদাই আয়াসোফিয়াকে যাদুঘর হিসেবে রাখার পক্ষে জোরালো ছিল এমনকি পাশের সুলতান আহমেদ তথা ব্লু মসজিদকেও যাদুঘরে রুপান্তরের কথা বলেছিল। তাদের মতে, এটা সেক্যুলার তুরস্কের প্রতিক! বিশ্বের মোড়লদের কাছ থেকে ‘সেক্যুলার’ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য আয়সোফিয়া জাদুঘর হিসেবেই সবচেয়ে পারফেক্ট। তুরস্কের সেক্যুলারদের অন্যতম ধারক-বাহক, নোবেল বিজয়ী ওরহান পামুকের স্টেটাস উল্লেখ করলেই সেক্যুলারদের আয়াসোফিয়া নিয়ে মোটিভ স্বষ্ট হবে, এটাকে মসজিদে পুন:রুপান্তর মানে বিশ্বকে এটা বলে দেওয়া যে; আমরা আর সেক্যুলার নই।”
একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে মামলা করা হয়। বেশকিছু সিভিল সোসাইটি এ মামলা পরিচালনা করে কিংবা মামলা পরিচালনায় সহায়তা করে। মামলার মূল বাদী ছিল Sürekli Vakıflar Tarihi Eserlere ve Çevreye Hizmet Derneği নামে একটি সিভিল সোসাইটি। মামলার গ্রাউন্ডগুলো ছিল;
১. আয়াসোফিয়া একটি ওয়াকফ সম্পত্তি। এটাকে যে কাজে ব্যবহার করার জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে সে কাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার আইনসঙ্গত নয়। আর ইস্তান্বুল বিজয়ের পর এটাকে ফাহিত সুলতান মেহমেদ কিনে নিয়ে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালের ট্যাক্স পে করার কাগজেও আয়াসোফিয়াকে মসজিদে হিসেবে লেখা আছে।
২. যাদুঘরে রুপান্তর করার নির্বাহী আদেশটি তড়িগড়ি করে লেখা হয়েছে যাতে ঐ বছরের আগের অধ্যাদেশের নম্বরের সাথে মিলেনা এমনকি আতাতুর্কের স্বাক্ষরটির ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করা হয়। কারণ, আতাতুর্ক নামে ওখানে স্বাক্ষর করা আছে কিন্তু মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নাম গ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৫ সালে (যাদুঘরে রুপান্তর করা হয় ১৯৩৪ সালে)।
যাক, আমি আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ নই, মামলার বিষয়ে আর সামনে আগাচ্ছি না। ২০০৮ সালে উপরের মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। আতাতুর্কের স্বাক্ষর রয়েছে এমন একটি ডকুমেন্ট বাতিল করবে এমন সাহস কিংবা চেতনা বিচার বিভাগের তখনো হয়ে উঠেনি, ইনফেক্ট বিচার বিভাগ তখনো কামালিজমকে হেফাজতের অতন্দ্র প্রহরী।
প্রসঙ্গত, ২০০৭-০৮ সালের আরেকটি ঘটনা আমার ‘এরদোয়ান দ্যা চেঞ্জ মেকার’ বইতে উল্লেখ করেছি। স্ত্রী হিজাব পড়েন এবং নিজেও একজন ইসলামিস্ট এই অপরাধে আব্দুল্লাহ গুলকে তখন প্রেসিডেন্ট হতে দেওয়া হয়নি কিংবা দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তখনকার এই বিচার বিভাগের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এরদোয়ানের বলিষ্টতা এবং জনগনের পুরোপুরি সাপোর্টে আব্দুল্লাহ গুল প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। বইতে বিস্তারিত লিখেছি এ বিষয়ে।
যাক, ২০০৮ সালে হেরে যাওয়ার পর বাদীপক্ষ থেমে থাকেনি। বারবার মামলা করেছে। আর এদিকে আয়াসোফিয়াকে মসজিদে পুন:রুপান্তর করার ক্যাম্পেইনও অনবরত চলমান ছিল। তুরস্কের বেশ কিছু সিভিল সোসাইটি এখানে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। দীর্ঘদিনের এই ক্যাম্পেইনের ফলাফলে আয়াসোফিয়ার পক্ষে জনতার কমপক্ষে ৭০% এর পজেটিভ মতামত রয়েছে বলে পরিসংখ্যানগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে। সেক্যুলার দলগুলোও এখন আয়াসোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার বিরোধীতা করতে পারেনা রাজনীতি রক্ষার ভয়ে। কারণ, জন সমর্থন এখন আয়াসোফিয়ার দিকে।
মজার ঘটনাটি ঘটেছে গত মাসে। এবারের ইস্তান্বুল বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যখন আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তরের ব্যাপারে পজেটিভ ইঙ্গিত দিলেন তখন তুরস্কের বিরোধী জোটের একটি ডানপন্থী দল তড়িঘড়ি করে পার্লামেন্টে একটি বিল নিয়ে আসলো, যাতে সমর্থন দেয় সিএইচপিও! বিলের বিষয় ছিল; আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তর করার জন্য গবেষণা করতে একটি কমিশন গঠন করা হোক। সরকারী জোট তা নাকচ করে দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল, আয়সোফিয়া মসজিদে রুপান্তরের বিষয় এখন গবেষণার ওপারে চলে গেছে, এখন বাস্তবায়নের পালা। জুলাইতে রায় হবে এরপরই এটাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।
গতকাল আয়াসোফিয়া মসজিদে রুপান্তরিত হওয়ার পর প্রায় সকল দলই এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে, অনেক দলই সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। সিএইচপির পক্ষ থেকে এখনো অফিসিয়াল বক্তব্য চোখে না পড়লেও তাদের খুববেশী সুযোগ নেই বিরুদ্ধে বিবৃত্তি দেওয়ার। তারা হয়তো চুপ থাকবে না হয় পক্ষে বিবৃতি দিবে। কারন, আয়াসোফিয়ার পক্ষে বিপুল জনমত।আর এটাকেই বলে পরিবেশ সৃষ্টি এবং চাপ।
আয়াসোফিয়া নিয়ে এই সময়ে এই সিদ্ধান্তটা বেশ ইঙ্গিত বহন করে। তুরস্কের ভূ-রাজনীতি বিশেষত সাইপ্রাস এবং ভূমধ্যসাগর ইস্যুতে গ্রীস-ইসরাইল জোটের সাথে বিরোধ, লিবিয়া এবং সিরিয়া ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সর্বশেষ মসজিদে আকসা-ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা হবে ঠিক সুলতান আব্দুল হামিদ খানদের ভূমিকার মতো। এর ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য শুভ নাকি অশুভ তা সময়ই বলে দিবে কিংবা শুভ-অশুভর নির্ণয় শুধু দুনিয়ায় নয় বরং আখিরাতে। এর বড় প্রভাব পড়তে পারে তুরস্কের অর্থনীতিসহ নানা সেক্টরে।
যা্ইহোক, আগামীর তুরস্কের রাজনীতি যে আরো প্রো-ইসলামিক হবে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান হয়তো চাইছেন, এখন ‘জাগার সময়’ মুসলিম চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়। জনগনকে ইসলামী চেতনায় সমুন্নত করার সময়। সামনে আরো কঠিন দিন আসছে হয়তো।
আমার একটি জায়গায় খুব গ্যাপ মনে হয়, আর তা হলো মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ানের পাশে দাড়ানোর মতো যদি আর দু-চারজন নেতা থাকতো তবে হয়তো মুসলমানদের এতো কষ্টে থাকা লাগতোনা। বিশেষত যদি আজ মিশরে ড. মুরসী থাকতেন তাহলে ফিলিস্তিনসহ অনেক দেশের অবস্থা আজ ভিন্ন হতো।