এক.
প্রায় তিন মাস পর ট্রামযোগে জরুরি একটা কাজে যাচ্ছিলাম। সামনের সীটের মাস্ক পরা তরুণ পেছনে ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো অমুক স্টেশন কোথায়? ওর গায়ের রং বলছে বাংলাদেশি, ইংরেজী বলার ধরণ দেখে আমার কাছে তার বাংলাদেশি হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেল। কোথায় যাবে সেটা শুনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলাম। বললাম, কোন দেশ থেকে এসেছেন?
-বাংলাদেশ।
কোন জেলা?
-রংপুর।
কোন উপজেলা?
-পীরগাছা।
বললাম, আই’ম অলসো ফ্রম বাংলাদেশ।
এতক্ষণ ইংরেজীতেই চলছিল। হাসি দিয়ে বাংলায় বলল- ‘তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নাই’। মাস্ক পরা থাকলেও ভাইটির খুশির ঝিলিক মেশানো হাসি আমার চোখ এড়াতে পারেনি। ইরাক, তুরস্ক, গ্রীস, সার্বিয়া হয়ে বসনিয়ায় এসেছেন, ইতালীতে ঢুকবেন তিনি। এরকম আরো অনেক বাংলাদেশি বসনিয়ায় আছে। তাদের অনেকের সাথে বিগত কয়েকদিনে দেখা হয়েছে, ওদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বিরিয়ানীসহ অনেক বাংলাদেশি রান্না খাইয়েছে।
একটু পরে পুলিশ আসলো টিকেট চেক করতে। পুলিশ ওনার সামনে আসতেই উনি আমাকে বলল, আমিতো টিকেট কাটিনি, টাকা দিলে কি হবে? আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছি, তখনি পুলিশ ওনাকে বলল- প্লিজ কাম উইথ মি। না, শাস্তি দেয়া, আ্যরেস্ট করা বা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়ার জন্য না। সাধারণত পুলিশ নিয়ে ড্রাইভারের কাছে যায়, ড্রাইভারের কাছ থেকে টিকেট কাটিয়ে পুলিশ তার দায়িত্ব শেষ করে।
আমি খেয়াল করলাম, পুলিশ তাকে ডাকলেও ড্রাইভারের কাছে নিয়ে যায়নি। কয়েক সীট সামনে পুলিশ তাকে বসিয়ে রেখেছে, তার সাথে আরেকজন বাংলাদেশি ছিল। আরেকটু পরে অন্য আরেকজন পুলিশ এসে তাদের দুজনকে টিকেট কাটতে বলতে লাগল। বিপত্তি বাঁধাল ডান পাশের দুই আন্টি। ছবিতে দেখতে আংকেলের মত লাগলেও মূলত তারা আন্টি। পেছনের আন্টি পুলিশের সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। আমি বসনিয়ান ভাষায় ২/৪ টা শব্দ ছাড়া বিশেষ কিছুই বুঝিনা।
যতটুকু আন্দাজ করলাম, আন্টি পুলিশকে বলছে- দুটো ভিনদেশি মানুষ টিকেট কাটেনি তাতে কি এমন হয়েছে? আমাদের দেশের অনেকেই তো টিকেট কাটেনা। ওরা অন্য দেশ থেকে এসেছে, হয়তো দরিদ্র হবে, ওদেরকে টিকেট কাটতে বাধ্য করতেই হবে কেন? পুলিশও কিছুটা উচ্চবাচ্য করে বাংলাদেশি ভাই দুজনকে কিছু না বলেই চলে গেল। আন্টি চোখের ইশারায় ওদেরকে বলল, কোনো সমস্যা নাই চুপচাপ বসে থাকো।
দুই.
বসনিয়ায় এসেছি মাত্র ক’দিন হলো। আসার সপ্তাহ খানেক পর ইতালীয় ফ্রেন্ডকে নিয়ে পায়ে হাটা দূরত্বে স্বাধীন বসনিয়ার রুপকার, জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ (র.) এবং যুদ্ধে নিহতদের কবর জিয়ারত করতে গেলাম। কবর জিয়ারত শেষে ফিরে যাওয়ার সময় ও বলল- চল, আমরা অন্য গলি দিয়ে যাই। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ। ওর কথামত অন্য গলি দিয়ে ঢুকে দু’জন গল্প করতে-করতে হাটছি আর আশেপাশের বাসাগুলোর জানালার ধারে চৌকোণা লম্বা টবে সাঁজানো বাহারী রকমের ফুলের সমাহার দেখে মাশাআল্লাহ্, ভেরি বিউটিফুল বলছি।
খানিকটা যাবার পর মনে হলো আমরা এই রাস্তায় এভাবে হাটতে থাকলে ডর্মিটরি খুঁজে পাবোনা। একদম নতুন হওয়ায় আন্দাজও করতে পারছিনা, কোন দিকে গেলে ভাল হবে। আমাদের কারো মোবাইলেই ইন্টারনেট নাই। নেট থাকবে কি করে, বসনিয়ান সিম কার্ড-ই নাই। হঠাৎ দু’জন মাঝবয়সী লোক দেখতে পেলাম।
সালাম দিয়ে ইংরেজিতে আমাদের দুর্দশার কথা বললাম। ওনারা দু’জন ইংরেজি তেমন একটা না বুঝলেও নবাগত দুই পথহারা তরুণের বিপদ ঠিকই বুঝলেন। বেশভূষায় মধ্যবিত্তের ছাপ। খুব একটা শিক্ষিতও নন বলে মনে হলো। ওনারা কোথাও যাচ্ছিলেন। আমাদের সমূহ বিপদ শুনে ওনারাও মহা বিপদে পড়ার মত হাপিত্যেশ করতে লাগলেন। একজন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে, আমাদের কাছ থেকে এড্রেস শুনে নিয়ে গুগল ম্যাপে ঢুকলেন।
বেশ কয়েক মিনিট খোঁজাখুঁজি করেও আমাদের কাঙ্খিত এড্রেস পাচ্ছেননা তিনি। পরীক্ষার হলে প্রশ্ন কমন না পড়লে কিংবা মুখস্থ প্রশ্ন মনে না আসলে যেমন অবস্থা হয়, ওনার চেহারায় আমি ঠিক সেইরকমই একটা অস্থিরতার ভাব লক্ষ্য করলাম। মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন, কিংবা আশে-পাশে তাকাচ্ছেন আর গভীরভাবে ভাবছেন। আমরাও লজ্জিত হচ্ছি এটা ভেবে যে, চলন্ত দু’জন মানুষকে হঠাৎ অযথা টেনশনে ফেলে দিলাম। পাশের লোকটিও মোবাইলের স্ক্রিনে বারবার উঁকিঝুঁকি মারছে, হা-হুতাশ করছে আর বসনীয় ভাষায় কি কি যেন পরামর্শ দিচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে লটারী জিতার খুশির মত মুখে হাসির রেখা টেনে হাতের ইশারায় বললেন- বাছাধনেরা, ঐ দিকের গলি ধরে সামনে এগুলে তোমাদের ডর্মে যাবার একদম সোজা রাস্তা খুঁজে পাবা। আমরাও একটু স্বস্তি খুঁজে পেলাম। আমরা কিছু বলতে না বলতেই ওনাদের একজন বলল, আসো আমাদের সাথে। প্রায় দশ মিনিট হেটে আমাদেরকে এমন একটি গলির মুখে নিয়ে গেলেন যেখান থেকে বাকীটা আমরা চিনি। এই দশ মিনিট ওনারা এমনভাবে আমাদের নিয়ে হাটছেন, যেন সেনাপতি তার সেনাদলকে রাজ্যজয়ের আশার বাণী শুনিয়ে সামনে এগুচ্ছেন, এইতো আরেকটু!
বললেন, এখন যেতে পারবা তো? আমি বেচারার মুখচ্ছবির দিকে আবারো খেয়াল করে দেখলাম, এতটা করেও উনি সন্তুষ্ট নন। রুমে পৌছিয়ে দিয়ে যেতে পারলে বোধহয় তৃপ্ত হতেন। অনেক বলে-কয়ে বুঝাতে সমর্থ হলাম যে, বাকীটা আমরা নির্বিঘ্নে যেতে পারবো। ওনাদের একরাশ ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে আমরা ডর্মের দিকে হাটছি আর দু’জন বলাবলি করছি, মানুষ এতটা আন্তরিকও হতে পারে?