ডা. জাকির নায়েক। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ইসলামিক স্কলার ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের (Comparative Religion) বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত। ইসলামের এই মহান দাঈর জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে। পড়াশোনা- মুম্বাইয়ের সেন্ট পিটার্স হাই স্কুল, কিশিনচাঁদ চেল্লারাম কলেজ, টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড নাইর হসপিটাল, অতঃপর ইউনিভার্সিটি অব মুম্বাই থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
ডা. জাকির বিশ্বখ্যাত সুবক্তা ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক শেখ আহমাদ দিদাতের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে দাওয়াতি কাজে জড়িত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম শুরু করেন এবং ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি মুম্বাইয়ের ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং ইউনাইটেড ইসলামিক এইডের প্রতিষ্ঠাতা, যা দরিদ্র ও অসহায় মুসলিম তরুণ-তরুণীদের বৃত্তি প্রদান করে থাকে। ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে তাঁকে ‘পিস টিভি নেটওয়ার্কের পৃষ্ঠপোষক ও আদর্শিক চালিকাশক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাঁর বক্তব্যের অসাধারণ গুণগুলো হল, তিনি তাঁর বক্তব্য কুরআন-হাদিস ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে তথ্য ও প্রমাণপঞ্জি পৃষ্ঠা, আয়াত, অধ্যায় ও খণ্ড নম্বরসহ উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তা যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপস্থাপন করেন। আর এসবের মিশেলে যে কোন প্রশ্নের তড়িৎ উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি বিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে কুরআনকে বিশ্বাস করার কথা বলেননি, কুরআন বোঝার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখেছেন। তাঁর এই গুণসমৃদ্ধ বক্তব্য দর্শক-শ্রোতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমোহিত করে রাখে। ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও নাস্তিক বুদ্ধিজীবীদের আনীত নানা অভিযোগ খণ্ডন করে ইসলামের সৌন্দর্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি রীতিমত কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
গত ২০ বছরে তিনি দুই হাজারের ঊর্ধ্বে পাবলিক লেকচার দিয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, হংকং, ঘানা, চাইনা, ত্রিনিদাদ, শ্রীলংকা, মালদ্বীপসহ আরো বহু দেশে। সবচে’ বেশি লেকচার দিয়েছেন তাঁর মাতৃভূমি ভারতে। তিনি অন্যান্য ধর্মের পন্ডিত ব্যক্তির সাথে সংলাপ ও বিতর্কে অংশ নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান হয়েছিলো আমেরিকার শিকাগোতে ২০০০ সালের ১ এপ্রিল। ‘বিজ্ঞানের আলোকে কুরআন ও বাইবেল’ শীর্ষক এই বিতর্কে ডা. জাকিরের প্রতিপক্ষ ছিলেন আমেরিকার একজন চিকিৎসক ও মিশনারি ব্যক্তিত্ব ডা. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল। এই অনুষ্ঠানে ডা. জাকির অত্যন্ত সফলভাবে উইলিয়াম ক্যাম্পবেলকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
তাঁর আরেকটি ঐতিহাসিক বিতর্ক হয়েছিলো ভারতের ব্যাঙ্গলোরে ২১ জানুয়ারি ২০০৬ । ‘প্রধান ধর্ম গ্রন্থের আলোকে হিন্দুইজম এবং ইসলাম’ শীর্ষক এই বিতর্কে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন ভারতের আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী রবী শংকর। এই বিতর্ক অনুষ্ঠানেও ড. জাকির নায়েক অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাকে পরাস্ত করেন। তার এসব বক্তৃতার অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ইসলামপ্রিয় মানুষের কাছে তিনি প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। তাঁর বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছে। ২০১২ সালের মার্চ মাসে ভারতে বিহারের কিশানগঞ্জে তাঁর এক পাবলিক লেকচারে প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হয়।
ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউব-টেলিভিশন সর্বত্র তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। তাঁর পরিচালিত টেলিভিশন পিস টিভি বাংলা-উর্দু-ইংরেজি এই তিন ভাষায় সম্প্রচারিত হয়। ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এর দর্শক-সংখ্যা ১০০ মিলিয়নের ঊর্ধ্বে। এদের মধ্যে ২৫% অমুসলিম। তাঁর বক্তব্য ও বিতর্কগুলো সিডি ও বই আকারে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বের হয়ে লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
১৯৯৪ সালে শেখ আহমাদ দিদাত ডা. জাকির নায়েককে ‘দিদাত প্লাস’ উপাধি দেন। ২০০০ সালের মে মাসে তাঁকে দাওয়াত ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর গবেষণার জন্য দেয়া এক স্মারক উপহারে খোদাই-করে লিখেছিলেন, “”Son what you have done in 4 years had taken me 40 years to accomplish – Alhamdullilah.” (বৎস, তুমি যা ৪ বছরে করেছ, তা করতে আমার ৪০ বছর ব্যয় হয়েছে। – আলহামদুলিল্লাহ।) ডা. জাকির নায়েক তার দাওয়াহ কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই। ২০১৫ সালে তিনি ইসলামের ওপর বিশেষ অবদান রাখার জন্য মুসলিমবিশ্বের নোবেল পুরস্কারতুল্য মর্যাদাপূর্ণ ‘কিং ফয়সল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ পেয়েছেন।
সম্প্রতি গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরায় ৫ হামলাকারীর মাঝে একজন ফেসবুকে জাকির নায়েকের অনুসারী ছিলেন বলে বাংলাদেশী পত্রিকা ডেইলি স্টারে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, “জাকির নায়েকের বক্তব্য আমাদের জন্য একটি নজরদারির বিষয়। আমাদের এজেন্সিগুলো এর উপর কাজ করছে।” (The Economic Times (New Delhi) ৬ জুলাই ২০১৬) এর ২ দিন পর মহারাষ্ট্র সরকারের সিআইডি বিভাগ তদন্তের ফলাফল হিসেবে জানায় যে, তারা জাকির নায়েকের বক্তৃতায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কোন প্রমাণ খুজে পায়নি। ডেইলি স্টার উক্ত বিতর্ক নিয়ে জাকির নায়েকের নিকট ক্ষমা চেয়ে মন্তব্য করে যে তারা কখনোই নায়েককে উক্ত হামলার জন্য দোষারোপ করে নি। পত্রিকাটি বলে যে, এটি শুধুমাত্র এটাই তুলে ধরেছে যে, কিভাবে তরুণরা তার বক্তব্যকে ভুলভাবে বুঝছে।(The Daily Star (Bangladesh) ৯ জুলাই ২০১৬)
তবে, এঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার নায়েকের পিস টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। এদিকে ভারতের শীর্ষ স্থানীয় আলেম দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও দেশটির সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানী ডা. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর দারুল উলুম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবদুল খালেক মাদরাসী মিডিয়াকে জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে দেওবন্দের পুরনো ফতওয়াকে ব্যবহার করতে নিষেধ করেন।
ডা. জাকির নায়েককে সন্ত্রাসবাদে উস্কানি দেয়ার অভিযোগের সাথে জড়ানোয় নিন্দা জানিয়ে ভারতের শীর্ষ স্থানীয় আলেম, দেশটির সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ এর সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানি বলেছেন, ‘জাকির নায়েক নিজের পদ্ধতিতে ইসলামের তাবলিগ করেন। আলেমরা তার সব কথার সাথে একমত নন। তিনি আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বও করেন না। কিন্তু তাকে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা।’
মাহমুদ মাদানি বলেন, শক্তিশালী প্রমাণ ছাড়া তাকে সন্ত্রাসবাদে উস্কানির দায়ে অভিযুক্ত করা ন্যায়নীতির পরিপন্থী। জাকির নায়েকের অনেক কথার সাথে বিভিন্ন মতের আলেমদের মতবিরোধ আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এই মতবিরোধ সন্ত্রাসবাদের সাথে তাকে যুক্ত করার ব্যাপারটি থেকে পুরোপুরি আলাদা। মাহমুদ মাদানি মনে করেন, সুষ্ঠু তদন্ত করে উপযুক্ত প্রমাণ পেলেই কেবল সরকার জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি মিডিয়াকে বাড়াবাড়ি পরিহার করে জাকির নায়েকের বিষয়টি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানান। (সূত্র: http://insaf24.com/news/8553)
ডা. জাকির আহলে হাদিস বা সালাফি মতাদর্শে প্রভাবিত হলেও তিনি নিজেকে আহলে হাদিস বা সালাফি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন না। তিনি নিজেকে একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি সবাইকে বলেন, আহলে হাদিস, সালাফি, হানাফি, শাফেয়ি, মালেকি, হাম্বলি ইত্যাদি পরিচয় না দিয়ে নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিন। এরকম পরিচয়ে গোঁড়ামি সৃষ্টি হয়। তিনি নিজে মাজহাব না মানলেও মাজহাবকে অস্বীকার করেন না। সকল ইমামের প্রতি তিনি শ্রদ্ধা পোষণ করেন বলে জানা যায় তাঁর বক্তব্য থেকে। পৃথিবীর সকল মানুষ একই দল, মত, মাজহাব বা চিন্তাধারার অনুসারী হবেন- এটা কল্পনাতীত ও অসম্ভব বিষয়। ফিকহ বিষয়ক কিছু বক্তব্য ও মন্তব্যের কারণে তিনি আলেমসমাজের সমালোচনার পাত্র হন। তিনি যদি এই অঙ্গনে প্রবেশ না করে তাঁর গুরু শেখ আহমাদ দিদাতের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এই সমালোচনা হত না। শেখ আহমাদ দিদাত ফিকহ ও ফতওয়া বিষয়ক আলোচনা মুফতিদের কাছ থেকেই জিজ্ঞেস করার জন্য বলতেন। ডা. জাকির নায়েক যেসব ফতওয়া দিয়েছেন তার অধিকাংশই শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি, শাইখ বিন বাজ, শাইখ সালেহ আল উসাইমিন প্রমুখ আলেমদের ফতওয়া। যদিও অনেক ক্ষেত্রে তিনি তাদের নাম উল্লেখ করেন না। তাঁর চিন্তার কিছু কিছু অংশ আলেমসমাজের নিকট সংশোধনযোগ্য।
ইদানীং তাঁর প্রশংসা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে। পক্ষের লোকেরা তাঁকে ‘মুজাদ্দিদ’, ‘মুজতাহিদ’ ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত করছেন। আর বিপক্ষের লোকেরা বলছেন, ‘ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল’, ‘গোমরাহ’ ইত্যাদি। তবে চিন্তাশীল আলেমদের মত হল তিনি ‘মুজাদ্দিদ’ বা ‘মুজতাহিদ’ও নন এবং ‘ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল’ ও ‘গোমরাহ’ও নন। অপর দিকে তিনি মুফতি ও ফকিহও নন। তিনি মূলত মেডিকেল সার্জন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক ও দাঈ ইলাল্লাহ। তাঁর কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে তা শালীন ও মার্জিত ভাষায় তথ্য ও যুক্তিনির্ভর পন্থায় চিহ্নিত করতে হবে, যাতে তিনি সংশোধনের সুযোগ লাভ করতে পারেন এবং সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত না হন। নিম্নে তাঁর সম্পর্কে কিছু আলেমের মত তুলে ধরা হল।
ডা. জাকির নায়েক ‘International Islamic Conference Urdu 2010’-এ বিশ্বখ্যাত আলেমে দীন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার মুহাদ্দিস সাইয়েদ সালমান হুসাইনী নদভীকে আমন্ত্রণ জানান। এ কনফারেন্সে আল্লামা সাইয়েদ সালমান হুসাইনী নদভী ডা. জাকির নায়েককে উদ্দেশ্য করে যা বলেছেন তা নিম্নে উল্লেখ করা হল-
‘আমি জাকির ভাইকে বলব, মানবতার কল্যাণের জন্য এই মঞ্চকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। এই মঞ্চ পারস্পরিক মতবিরোধ চর্চার জন্য নয়; মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-বিবাদের জন্যও তৈরি হয়নি এই প্লাটফর্ম। মুসলমানদেরকে দেওবন্দি-বেরলভি, শিয়া-সুন্নি, সালাফি-হানাফি, মুকাল্লিদ- গাইরে মুকাল্লিদসহ নানা উপদলে বিভক্ত করে দলাদলি করাও এর উদ্দেশ্য নয়। এখানে সর্বসম্মত মাসআলা নিয়ে আলোচনা হবে। মতবিরোধপূর্ণ মাসায়েলের জন্য রয়েছে হাজারো মাদরাসা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জামেয়া (ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)।
এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য অনেক গবেষণা ও পঠন-পাঠন চলছে। অনেক ফিকহি কিতাব রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমি বড়ই ব্যথিত হয়েছি, শিয়া ও বেরলভিরা জাকির সাহেবের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। দেওবন্দিরা তাঁর ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এখন আমাদের কথা হল, জাকির সাহেবের বক্তব্যে কেউ যদি নারাজ হন, তবে প্রথমে জানতে হবে কোন ভুলের কারণে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন, কোন ভুল থেকে তাঁকে তওবা করতে হবে।
আমি জাকির নায়েক সাহেবকে ভালভাবে জানি; বিশ বছর ধরে তিনি আমার বন্ধু। আমি তাঁকে বলব, আপনি মুফতি হবেন না, মুজতাহিদ হতে যাবেন না। আপনার কাজ ফতওয়া দেওয়া নয়। নতুন নতুন মাসআলা জাতির সামনে পেশ করাও আপনার দায়িত্ব নয়। আপনি সারা বিশ্বের সামনে ইসলামকে তুলে ধরুন। অমুসলিমদের কাছে পৌঁছে দিন ইসলামের মর্মবাণী। আপনি আমেরিকার বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়ুন। ইউরোপের বিপক্ষে আওয়াজ তুলুন। জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মজলুমদের পক্ষে থাকুন। আপনি মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধগুলো সামাল দিন। উম্মতের ঐক্য অটুট রাখতে সহায়তা করুন।
আমি বেরলভি, শিয়া, দেওবন্দি ও অদেওবন্দি সকল ভাইদের বলব, জাকির সাহেব কোন ভুল করলে, তবেই তাঁর সংশোধনের পদক্ষেপ নিন। কিন্তু উম্মতের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করবেন না; তাদের একতায় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।এই মঞ্চ একতার, এই মঞ্চ শান্তির। সত্য ও কল্যাণের প্রতি আহ্বান করার জন্য এই প্লাটফর্ম। এখান থেকে একতা ও ভালোবাসার দাওয়াত দিতে হবে। আমরা উম্মতের মতবিরোধগুলোকে উস্কে দেব না। আমরা অনৈক্য চাই না।
আমি দৃঢ় আশাবাদী, ইনশাআল্লাহ এই মঞ্চ থেকে শান্তির আওয়াজ শুনা যাবে। ‘ওবামা’ও এই মঞ্চ থেকে উপকৃত হবেন, ইউরোপের নেতৃবৃন্দও এই মঞ্চ থেকে উত্থিত আহ্বানে কান পাতবেন। জালেম পাবে জুলুম থেকে বাঁচার প্রেরণা। মজলুম মানুষেরা লাভ করবে সান্ত্বনা। এখান থেকে গোটা পৃথিবীকে কল্যাণের প্রতি আহ্বান করা হবে। সকল মতবিরোধকে পাশ কাটিয়ে আমরা একতার বন্ধনে আবদ্ধ হব। আল্লাহ তাআলা এই কনফারেন্স ও এই চ্যানেলকে কবুল করুন। আমরা বেশি বেশি আত্মসমালোচনা করব। হকপন্থী আলেম ও ইসলামের সকল প্রতিনিধিদের ভালোবাসব। আল্লাহ তাআলা সবাইকে ভালোবাসার এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার তৌফিক দিন। আমাদের হৃদয় থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা ইত্যাদি বের করে দিন। -শ্রুতিলিখন ও অনুবাদঃ হাবীবুল্লাহ।
(সূত্র: ইউটিউব লিঙ্ক- youtube.com/watch?v=5AvZxl9AI0k&feature=share)
ডা জাকির নায়েক সম্পর্কে ভারতের প্রখ্যাত দাঈ মাওলানা কালিম সিদ্দিকী (দা.বা.)-এর মত তাঁর এক সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করছি। মাওলানা ওমর নাসেহীঃ প্রচার মাধ্যম, যেমনঃ টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করাটা কেমন? বর্তমানে ডাক্তার জাকির নায়েক পিস টিভির মাধ্যমে যে কাজ করছেন এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
মাওলানা কালিম সিদ্দিকীঃ আমি প্রচার মাধ্যমগুলোকে তাবলীগেরই মাধ্যম মনে করি। মনে করি, পৃথিবীর প্রতিটি কাঁচাপাকা ঘরে ইসলাম পৌঁছে দেয়ার জন্যে এই প্রচার মাধ্যমগুলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই একটি ব্যবস্থা। এগুলো ব্যবহার করার মতো সুযোগ যাদের আছে তাদের উচিত এ সুযোগকে কাজে লাগানো। ডাক্তার জাকির নায়েক এবং তাঁর পদ্ধতিতে যারা দাওয়াতের কাজ করছেন আমি তাঁদেরকে মর্যাদার সাথেই দেখি। তবে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী আলেমদের কথা হল- ডাক্তার জাকির নায়েক ও তাঁদের মতো দায়ীদের কাজ হল কেবল দাওয়াতের মধ্যেই নিজেদেরকে নিমগ্ন ও সীমাবদ্ধ রাখা। মাসলাক ও ফিকহী গবেষণা থেকে বিরত থাকাই তাঁদের জন্য সঙ্গত। অধম এ বিষয়ে তাঁদের সাথে একমত।
আমি স্বীকার করছি, ডাক্তার জাকির নায়েকের দ্বারা কোন ফায়দা হচ্ছে না, এমনটা বলা সঙ্গত নয়। আমি বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক অমুসলিমকে পেয়েছি যারা পিস টিভি দেখে প্রভাবিত হয়েছে। তারপর ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে শুরু করেছে। তাদের কেউ কেউ অন্য কোন মাধ্যমে গিয়ে মুসলমান হয়েছে। সুতরাং বৈধতার ভেতরে থেকে প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করাটাকে আমি সমর্থন করি। বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে ইসলাম সম্পর্কে প্রচারিত যেসব ভুল ধারণা রয়েছে যেমন- ইসলাম তলোয়ারের মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে, ইসলামে বহু বিবাহ ইত্যাদি এসব প্রচার মাধ্যমকেই কাজে লাগিয়ে দূর করা সম্ভব। যারা এক্ষেত্রে কাজ করছেন তাঁদের কাজের ইতিবাচক ফলাফলকে মূল্য দেওয়া উচিত। যদি সেখানে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন মন্দ দিক প্রমানিত হয় তখন সেটা আন্তরিকতার সাথে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দূর করতে চেষ্টা করা উচিত।
(সূত্র: দায়ী-এ ইসলাম হযরত মাওলানা কালিম সিদ্দিকী দা.বা. -এর আত্মজীবনীমূলক সাক্ষাৎকার, লেখক-মাওলানা ওমর নাসেহী, অনুবাদক-মুফতি যুবায়ের আহমদ। পৃষ্ঠা- ৫৬-৫৭; মাসিক আরমুগান, মে ও জুন ২০১০ইং, )
তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলেমে দীন, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, সুলেখক ও সুবক্তা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন লিখেন- ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট, ও ব্লগে ডা জাকির নায়েকের পক্ষে বিপক্ষে বিস্তর লেখালেখি শুরু হয়েছে; প্রকাশিত হয়েছে অনেক পুস্তিকা। পক্ষের লোকেরা বলছেন তিনি ‘মুজাদ্দিদ’, ‘মুজতাহিদ’ এবং বিপক্ষের লোকেরা বলছেন তিনি ‘খ্রিস্টানদের এজেন্ট’ ও ‘পথভ্রষ্ট’। আমাদের বিবেচনায় দু’টো মতই চরম্পন্থা ও তিনি মুজাদ্দিদ বা মুজতাহিদও নন এবং খ্রিস্টানদের এজেন্ট বা পথভ্রষ্টও নন। অপর দিকে তিনি মুফতীও নন এবং ফকীহও নন। তিনি মূলত ম্যাডিকেল সার্জন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক ও দাঈ ইলাল্লাহ। যার যা প্রাপ্য তা তাকে দিতে কার্পণ্য করা উচিৎ নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তে যিনি ইসলামের পক্ষে কাজ করবেন, তিনি আমাদের ভাই এবং দীনের পক্ষের শক্তি। তাঁর কোন ত্রুটি বা ভুল থাকলে আমরা শালীন ভাষায় ও যুক্তিনির্ভর পন্থায় তা চিহ্নিত করবো; যাতে তিনি সংশোধনের সুযোগ লাভ করতে পারেন এবং সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত না হন।’ (সূত্রঃ আত্-তাওহীদ, মার্চ ২০১২)
গত ১৩/৭/১৬ইং তারিখের ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ওচিন্তাবিদ ড. এ বি এম হিজবুল্লাহ লিখেছেন- ‘ডাঃ জাকির নয়েক সম্পর্কেও রয়েছে নানা মত। যেহেতু তিনি আলেম বা মুফতী নন সেহেতু তিনি মাসআলা মাসাইলের ক্ষেত্রে কোন ফাতওয়া বা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি যেটা করতে পারেন সেটা তিনি যার দ্বারা প্রভাবিত শাইখ আহমাদ দীদাতের পথ অনুসরণ করতে পারেন। তাকে কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, আমি মুফতী নই। এগুলো মুফতী সাহেবদের নিকট জিজ্ঞাসা করুন।
জী, এটা যেমন ঠিক অনুরূপ এ কথাও মানতে হবে তিনি একজন মেধাবী ও ক্ষুরধার তেজস্বী বক্তা। তুলনামূলক ধর্মতত্বে তিনি অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অনুরূপ সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে তিনি সোচ্চার। ৯/১১ হামলার পর যখন সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিরূদ্ধে হৈচৈ শুরু হয় তখন তিনিই বজ্রকন্ঠে সব অভিযোগ খন্ডন করে ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই প্রমাণ করেছিলেন। এটাকে শত্রু মিত্র কেউই অস্বীকরা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি মাযহাব অস্বীকার করেন না। পাশাপাশি তিনি নির্দিষ্ট কোন মাযহাবকেও অনুসরণ করেন না। সালাফী আমল ও আকীদায় বিশ্বাসী। তবে শিরক, বিদআত ও শীয়া মতবাদের সাথে কোন আপোষ করবেন না বলে আলাপ চারিতায় জানিয়েছেন।’
ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ডা. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ব্লগ, পেজ ও বইয়ে লেখালেখি হয়েছে। সেসবের কিছু আমি যাচাই করে দেখেছি। তাতে বেশ কিছু ভুল উদ্ধৃতি, খণ্ডিত উদ্ধৃতি বা উদ্ধৃতিহীন মন্তব্য লক্ষ্য করেছি। উক্তি ও মন্তব্যের ক্ষেত্রে সমালোচনা বা পর্যালোচনা করার জন্য সঠিক ও যথার্থ উদ্ধৃতি থাকা অপরিহার্য। ডা. জাকির তাঁর অনেক বক্তব্যে বলেছেন আমি একজন ছাত্র। তাই আমার ভুল হতেই পারে। কেউ যদি কুরআন ও হাদিস দিয়ে আমাকে আমার ভুল শুধরে দেন, তাহলে আমি তা সাথে সাথে মেনে নেব। তাই আমাদের ভিন্নমত বা সমালোচনা করতে হলে তা গঠনমূলক হতে হবে, হিংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক নয়। মার্জিত ও শালীন ভাষায় হতে হবে, বালখিল্য ও স্থুল আলোচনা কিংবা কূটতর্ক নয়; সঠিক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।