রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কয়েক বছর পূর্বে তার পরিবারে জন্ম নেন একজন শিশু, যিনি কিনা রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওতের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাশে ছিলেন এবং তিনি হলেন সেই মেয়ে যিনি কিনা রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর পর তার বংশ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই মিলিত হবেন বলে সুসংবাদ লাভ করেছিলেন।
তিনি হলেন ‘বেহেশতবাসী নারীদের নেত্রী।’ সেই নারী আর কেউ নন বরং আমাদের রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কনিষ্ঠ কন্যা ‘হযরত ফাতিমা’ (রাদ্বি আল্লাহু আনহা)।
রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়ত লাভের প্রথমেই উনার স্ত্রী আর মেয়েরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়ত লাভের পূর্বেই তারা উন্নত মানের নৈতিক গুণাবলি বিভূষিত হন। ইসলামের ছায়াতলে আসার পর তা আরো সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের কথা মানুষকে জানিয়ে দিলেন সেই সময় তিনি ফাতিমা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) ‘কেও বললেন “হে ফাতিমা! আগুন থেকে তোমরা নিজেদের রক্ষা কর। আল্লাহ থেকে তোমাদের (কিয়ামতের দিন) রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই, তোমাদের সঙ্গে আমার নিকট সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন।”
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নবুওয়ত লাভ করেন তখন ফাতিমা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) ছিলেন অনেক ছোটো, তাই বলা যেতে পারে ফাতিমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) বেড়ে উঠা ইসলামের মধ্যেই।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইসলামের দাওয়াত দিতেন তখন মক্কার কাফিররা তাকে নিয়ে অনেক বাজে বাজে কথা বলতো, বিদ্রূপ করতো, হাসি-তামাশা তো লেগেই থাকতো, তারা রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক প্রকার মানসিক অত্যাচার করতো। আর এসবের সবই বুঝতেন আদরের ছোট্ট কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
ক্বা’বায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন সালাত আদায় করছিলেন, পাশে বসে থাকা কুরাইশদের নেতাদের একজন যার নাম ‘উকবা’, সে উঠের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘাড়ের উপর রেখে দিলো, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন সিজদারত অবস্থায় ছিলেন।
তিনি তখন মাথা তুলতে পারেননি। খবর যখন ফাতিমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) কাছে আসলো তখন তিনি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে ফেলে দেওয়া উঠের নাড়িভুঁড়ি সেখান থেকে সরালেন এবং সেই নেতাদের সামনে গিয়ে তাদেরকে কটু কথা শুনিয়ে দেন। সর্বদাই তিনি রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে ছিলেন।
হিজরতের পরও তিনি রাসুলুল্লাহর কাছেই থাকতেন সর্বদা। মদিনায় হিজরতের পর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ‘আলী ইবনে আবী তালিবের’ (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) সাথে। সাংসারিক জীবন খুবই সিম্পল ছিলো তাদের, না ছিলো আরাম-আয়েশ বা বিত্তশালী হওয়ার ইচ্ছা। পিতৃগৃহ ত্যাগ করে যা স্বামী গৃহে যান সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিলো না, ছিলো দারিদ্র্যের কঠোর বাস্তবতা। তবুও তারা তাদের দাম্পত্যজীবনে অতন্ত সুখী ছিলেন আর আমাদের সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা অসুখী।
ফাতেমা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) ঘরের কাজ সব নিজে সামলাতেন বা করতেন। তাঁর এই কষ্ট দেখে আলী (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তারও কিছু করার ছিলো না, তিনিও তাকে কাজে সাহায্য করতেন।
একদা যুদ্ধ থেকে বেশ গণিমতের মাল ও যুদ্ধবন্দী আনা হয় মদিনায়, আলী (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) ফাতিমাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পাঠেলেন একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে যাতে ফাতিমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) কষ্ট লাঘব হয়। কিন্তু তিনি গিয়েও ফিরে আসলেন লজ্জ্বায় কথাটি বলতে পারলেন না।
এবার আলী (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) ও তিনি পিতার নিকট গিয়ে প্রয়োজনের কথাটি বললেন, জানতে চান দুনিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মেয়েকে কি জবাব দিয়েছেন? তাহলে শুনুন, তিনি উত্তরে বললেন “আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আমি একটিও দাস দেবো ন।” ফিরিয়ে দিলেন প্রাণপ্রিয় কন্যা ও তার স্বামীকে।
ফিরিয়ে দিয়ে যে তিনি পরম শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। রাতে তিনি তার মেয়ের বাড়ি গিয়ে কিছু জিনিস শিখিয়ে দিয়ে আসেন যা কিনা এই দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের লাভবান হতে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, “আমার কাছে তোমার জন্য দাসের চেয়েও ভালো কিছু আছে। তুমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়ে নাও। এটাই তোমার জন্য ভালো।”
ইনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির মেয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন তার মেয়ের সাংসারিক কী অবস্থা ছিল। তিনি চাইলে অনেক কিছু দিতে পারতেন কিন্তু না তিনি তা দেননি, এর পর থেকে ফাতিমা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) আরোও কাজে মশগুল হয়ে পড়লেন, আর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিখিয়ে দেওয়া সেই কাজ প্রত্যেকদিন করতে লাগলেন।
বিনিময়ে তিনি কী পেলেন? তিনি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। তাহারই কোলে জন্ম নেনে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) দুই প্রিয় দৌহিত্র ‘হাসান ও হুসাইন।’ মুসলিম উম্মাহর দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হন তাহারা।
রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর সময় তিনি তার পাশেই ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কানে কানে কি যেনো প্রথমে বলেছিলেন তা শুনে তিনি কেঁদে উঠলেন, পরে আবার তাকে ডাক দিয়ে কি যেনো কানে কানে বললেন তখন তিনি হেসে উঠলেন।
উম্মুল মূ’মিনিন আয়িশা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) কয়েক মাস পর জিজ্ঞেস করলেন যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুশয্যায় আপনাকে কি বলেছিলেন কানে কানে? তখন তিনি বললেন যে, সেদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সআল্লাম) প্রথমে বলেছিলেন, “আমি মারা যাবো। আমার পরে তুমিও কিছুদিন পর মারা যাবে।” আমি একথা শোনে কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার কান্না দেখে, তিনি দ্বিতীয়বার কানে কানে বললেন “তুমি হবে জান্নাতে নারীদের সর্দার।” একথা শোনে আমি হেসে দিয়েছিলাম।
পিতাকে যেমন তিনি ভালোবাসতেন, পিতাও তাকে অনেক ভালোবাসতেন। তাই তো পিতার মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই পরাপারে পাড়ি জমান এই মহীয়সী নারী। দুনিয়াতে থাকাকালীন কোনদিন তিনি আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করেননি। একজন সাধারণ মানুষের মতই তার জীবন অতিবাহিত হয়েছিলো। জ্ঞান, বিজ্ঞতা কোনকিছুতে কমতি ছিলো না তার। ইসলামের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী হয়ে রয়ে যান ইতিহাসের পাতায়।
তিনি এতটাই পর্দানশীন ছিলেন যে মৃত্যুশয্যায় তিনি আসমা বিনতে উমাইসকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) বলেন যে, মানুষ যেনো উনার শরীরের আকার না বুঝতে পারে তাই তার জানাযা যেনো করা হয় রাতের আঁধারে এবং দাফন। এই ছিলো উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)