জ্ঞানী-গুণী ও সম্মানিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন উপাধি অথবা লকবের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। ‘উপাধি’ ব্যক্তির সঠিক পরিচয়, সঠিক অবদান এবং সঠিক প্রভাব জানতে মানুষকে সাহায্য করে। তার প্রকৃত, প্রভাবনীয় অবস্থান তুলে ধরে।
আল্লাহ তায়ালাও পবিত্র কুরআনে তার নবিদেরকে (আলাইহিমুস সালাম) বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যেমন: হজরত ঈসাকে (আ.) ‘মাসিহ্’, মূসাকে (আ.) ‘কালিমুল্লাহ্’ আর ইব্রাহীমকে (আ.) ভূষিত করেছেন ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধিতে।
রাসুলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবিদের নানাবিধ যোগ্যতা বিবেচনায় নানান উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। তিনি হজরত আবু উবায়দা আমের ইবনুল জাররাহ্কে (রা.) ‘আমিনু হাজিহিল উম্মাহ্’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। আলীকে (রা.) ‘আসাদুল্লাহ্’ এবং খালিদ ইবনু ওয়ালিদকে (রা.) উপাধি দিয়েছিলেন ‘সাইফুল্লাহ্’।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে আজ অব্দি এমন বহু উপাধি বিভিন্ন ক্ষেত্রের পুরোধা ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তন্মধ্যে, ‘শায়খুল ইসলাম, হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমামুল হারামাইন, শায়খুল হিন্দ, মুজাদ্দিদে জামান, ইমামুল আজম, শায়খুল হাদিস, শায়খুল কুররা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইসলামি শরিয়তের বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত আরেকটি উপাধি হলো– ‘আল্লামা’। যার অর্থ : মহাজ্ঞানী ও পণ্ডিত।
‘কামুসুল আলকাব’ গ্রন্থে বলা হয়েছে— আল্লামা শব্দটি সাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা শুদ্ধ নয়। যদি না ব্যক্তির জ্ঞানচর্চায় গভীর পাণ্ডিত্য ও স্বতন্ত্র অবস্থান না থাকে।
আমাদের উপমহাদেশে এই উপাধিতে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘আল্লামা ইকবাল’ নামে প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলতে গেলে আল্লামা আহমাদ শফী, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী (রহিমাহুল্লাহু আনহুম) এই উপাধিতে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। ‘আল্লামা’ উপাধি উক্ত তিনজন আলিমকে জনসাধারণের মধ্যে অন্যরকম প্রভাবনীয় গ্রহনযোগ্যতা এনে দিয়েছে।
২০২৩ সালের ১৪ ই আগস্ট বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী প্রসিদ্ধ দাঈ ইলাল্লাহ্, আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী রহিমাহুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছেন।
আল্লামা সাঈদী ছিলেন সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের কুরআনের অন্যতম ডাহুক।
এই দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় তিনি দারাজ কন্ঠে, দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন ইসলামের সুউচ্চ মাকাম, কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব, শিরকের মূলোৎপাটন এবং বিদআতের ভয়াবহতা। তিনি কারও পরোয়া না করে নির্বিকচিত্তে ডিফেন্ড করেছেন ইসলামকে। আমৃত্যু পথ চলেছেন শির উঁচিয়ে ও ঈমানী চেতনায়। মনে মনে লালন করেছেন শাহাদাতের তৃপ্তিদায়ক তামান্না।
বাংলার মানুষ মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে ‘আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী’ বলে সম্বোধন করেন। ১৯৯১ সালে Muslim Ummah of North America— MUNA তাকে ‘আল্লামা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
আল্লামা সাঈদী তার বরকতপূর্ণ জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
[ক] ১৯৭৬ সালে তিনি তৎকালীন সৌদি বাদশাহের আমন্ত্রণে পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেছিলেন।
[খ] ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি রমাদান মাস বাইতুল্লাহ্ ও মসজিদে নববিতে অতিবাহিত করেছিলেন। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে, ধারাবাহিকভাবে রমাদানে বাইতুল্লাহ্ তাওয়াফ ও ওমরাহ্ করেছেন। কখনও ইতিকাফে ছিলেন মসজিদুল হারামে, কখনও-বা মসজিদে নববিতে।
[গ] ১৯৯১ সালে কুয়েত-ইরাক যু/দ্বের মীমাংসায় সৌদি সরকার মধ্যস্থতা করেছিলো। কিভাবে এই লড়াই থামানো যায়, তার পরামর্শ গ্রহণের লক্ষ্যে পৃথিবীব্যাপি প্রথিতযশা ইসলামের পণ্ডিতদের সৌদি সরকার কতৃক আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই আমন্ত্রিত অতিথিদের (প্রায় ৪০০ জন) মধ্যে পরামর্শক হিশেবে আল্লামা সাঈদীও ছিলেন।
সৌদি সরকার ৪০০ জন আমন্ত্রিত অতিথিদের পবিত্র কা’বায় প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। এদিকে আল্লামা সাঈদীরও বহু দিনের মাকসাদ ছিলো কা’বার অন্দরে প্রবেশ করা। অবশেষে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তার সেই নেক মাকসাদ পূরণ করেন।
[ঘ] ২০০০ সালের ৮ই ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের আমন্ত্রণে আল্লামা সাঈদী আরব আমিরাত সফর করেছিলেন। সেখানে প্রায় ৫০ হাজার বাংলা ভাষাভাষী প্রবাসীর সামনে তিনি কুরআনের তাফসির করেন।
[ঙ] তিনি লন্ডন ইসলামিক সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেন। একই অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাইতুল্লাহ্’র সম্মানিত ইমাম শাইখ আব্দুর রহমান আস-সুদাইস। সেই অনুষ্ঠানে তিনি প্রায় ছয় শতাধিক মানুষকে ইসলামের সুশোভিত বাগানে আমন্ত্রণ জানান।
জালিমের কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার পর তার প্রতি আপামর জনতার শোক প্রকাশ নব ইতিহাসের সূচনা করেছে।
আল্লামা সাঈদী আরও বহুকাল বহুযুগ ধরে ইসলামপ্রিয় মানুষদের অন্তরে চর্চিত হবেন, তার কাজের ধরণ হবে আমাদের জন্য অনুকরণীয়, তার অবদান এবং আবেদন থেকে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন তার অবদান দিয়ে, আবেদন দিয়ে, ইখলাস দিয়ে।
আল্লামা সাঈদীর উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশে কুরআনের রাজ কায়েম করা। বাংলাদেশের মানুষকে আল্কাহ সচেতন এবং কুরআন সচেতন করা। তিনি সে চেষ্টা আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন। তিনি এ দেশের মানুষকে সাম্রাজ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ এবং জাতীয়তাবাদের আগ্রাসন সম্পর্কে সদা সতর্ক করতেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে মাঠের নিরক্ষর কৃষকের কান পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশবিভুঁইয়েও ইসলামের কথা বলেছিলেন। জড়িত ছিলেন আর্থসামাজিক ও জনকল্যাণমুখী নানাবিধ কাজের সাথেও।
একজন মানুষ যদি একটা ভূখণ্ডের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, কম শিক্ষিত এবং নিরক্ষর— সকল মানুষদের মনের ভাষায় কুরআনের কথা, সুন্নাহর কথা বলতে পারেন। বুঝাতে পারেন আল্লাহর পরিচয়, কুরআনের পরিচয়, শিরকের ভয়াবহতা। তাহলে, তিনি মানুষের কাছে জ্ঞানী, পণ্ডিত এবং মানুষের ‘আল্লামা’।